নেপালের উদ্দেশ্যে দেড় মাস আগে যখন তিনি দেশ ছেড়েছিলেন, তখন বলেছিলেন, বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা তার লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যপূরণে এই তরুণ বেশি সময় নেননি। রবিবার (১৯ মে) সকালে এভারেস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন চট্টগ্রামের পর্বতারোহী বাবর। এভারেস্ট জয়ে ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে এই কৃতীত্ব অর্জন করলেন বাবর, আর চট্টগ্রামের কোনো পর্বতারোহীর এটাই প্রথম এভারেস্ট জয়।
জানা যায়, নেপালের স্থানীয় সময় সাড়ে আটটায় মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েছেন বাবর আলী। ১১ বছর প্রতীক্ষার পর বাংলাদেশের কেউ আবার এভারেস্ট জয় করল। এর আগে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের আমা দাবালাম চূড়া জয় করেছেন বাবর।
এর আগে ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করেন। এরা হলেন মুসা ইব্রাহিম, এম এ মুহিত (দুবার), নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া নাজরীন ও মো. খালেদ হোসাইন।
বাবর পেশায় একজন চিকিৎসক। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বুড়িশ্চর এলাকার লেয়াকত আলী এবং লুৎফুন্নাহার বেগমের দ্বিতীয় সন্তান বাবর ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১ তম ব্যাচের ছাত্র। কিছুদিন জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করলেও আগের অভিযানের সময় ছুটি না মেলায় চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। এই যাত্রায় মাউন্ট এভারেস্টের পর লোৎসে জয়ের অভিযানে যাওয়ার কথা রয়েছে বাবরের।
এই অভিযানের বিষয়ে জানাতে গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন বাবর। পরদিন ১ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে নেপালের উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি। ৪ এপ্রিল কাঠমান্ডু থেকে পৌঁছান লুকলাতে। সেখান থেকে পথচলা শুরু করে ১০ এপ্রিল বাবর পৌঁছে যান এভারেস্ট বেসক্যাম্পে।
বাবরের যাত্রাপথের দিনলিপি
বাবরের এভারেস্ট যাত্রার প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান জানান, “এভারেস্ট অভিযানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হল একাধিকবার উচ্চতায় উঠানামা করে উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। কিন্তু কয়েকদিন অপেক্ষার পরও নেপালের দায়িত্বরত দল পথ তৈরি করতে পারেনি।
“তাই বাবর বিকল্প বেছে নেন, ১৬ এপ্রিল সামিট করেন ২০০৭৫ ফুট উচ্চতার লবুচে ইস্ট পর্বত। এরপর আবারো বেসক্যাম্পে ফিরে পর্বতের নিচ অংশের পথ খুলে গেলে ২৬ এপ্রিল বেসক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে ক্যাম্প-২ পর্যন্ত ঘুরে এসে শেষ করেন উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব।”
জামান জানান, এরপরই ১৪ মে মাঝরাতে বেসক্যাম্প থেকে শুরু হয় বাবরের স্বপ্নের পথে যাত্রা। “তিনি প্রথম দিনেই সরাসরি উঠে আসেন ক্যাম্প-২ এ, যার উচ্চতা ২১,৩০০ ফুট। পরিকল্পনা অনুসারে সেখানে দুইরাত কাটিয়ে বাবর ১৭ মে উঠে আসেন ২৪,৫০০ ফুট উচ্চতার ক্যাম্প-৩ এবং ১৮ মে আসেন ক্যাম্প-৪ এ।”
জামান বলেন, “২৬,০০০ ফুট উচ্চতার এই ক্যাম্পের উপরের অংশকে বলা হয় ডেথ জোন। অবশেষে ১৮ মে মাঝরাতে আবারো শুরু হয় বাবরের যাত্রা, এবং ভোরের প্রথম কিরণে ২৯০৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্ট শীর্ষে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশের পতাকা।”
তবে বাবরের অভিযান এখনো শেষ হয়নি। শুধু এভারেস্ট নয়, সঙ্গে লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ শীর্ষ পর্বত লোৎসেও বাবর জয় করতে চান বলে জানান ফারহান জামান। তিনি বলেছেন, বাবরের নতুন অভিযান শুরু হবে রবিবার, এদিন তিনি ক্যাম্প-৪ এ নেমে মাঝরাতে আবারো শুরু করবেন দ্বিতীয় লক্ষ্যের পথে যাত্রা এবং সব অনুকূলে থাকলে সোমবার ভোরে পৌঁছে যাবেন পর্বত লোৎসের চূড়ায়।
এখন পর্যন্ত লোৎসে চূড়ায় কোনো বাংলাদেশি নাগরিকের পদচিহ্ন পড়েনি জানিয়ে জামান বলেন, “লোৎসে জয় করতে পারলে একসাথে দুই পর্বতশৃঙ্গ জয়ে প্রথম বাংলাদেশি হবেন বাবর আলী। লোৎসের উচ্চতা ২৭ হাজার ৯৪০ ফুট।”
পবর্তারোহীদের সংগঠন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, নেপালের স্নোয়ি হরাইজন নামক প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই অভিযানে বাবরের সাথে ছিলেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং পর্বতারোহণ গাইড বীর বাহাদুর তামাং।
জামান বলেন, “বাবর আলীর এই সাফল্য শুধু তার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং এটি পুরো বাংলাদেশের জন্য এক গর্বের বিষয়। এটি আমাদের দেশের তরুণদেরকে আরও বড় স্বপ্ন দেখার এবং সেগুলি পূরণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। এই অভিযানের পেছনে ছিল অসংখ্য মানুষের অবদান এবং স্বপ্ন। আমরা তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই।”
২০১৪ সালে পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স প্রতিষ্ঠার পর হতেই ক্লাব সতীর্থদের নিয়ে নেপাল এবং ভারতের বহু পর্বতে অভিযান করেছেন বাবর। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি সামিট করেছেন নেপালের আমা দাবলাম পর্বত। এই অভিযানের মোট খরচ হচ্ছে ৪৫ লাখ টাকা। যাতে মূল পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছেন ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যার লিমিটেড। এছাড়া সহ-পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ঢাকা ডাইভার্স ক্লাব, বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ব্লু জে, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনী, গিরি, ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স। এছাড়াও অভিযানের জন্য গণ তহবিল সংগ্রহে অংশ নিয়েছেন দেশে-বিদেশে নানা সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠন এবং অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষী। অভিযানের সার্বিক সমন্বয় করেছে বাবর আলীর নিজের ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স।