০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

যেভাবে বাংলাদেশে রিকশা এলো

মিনহাজুল ইসলাম শান্ত
০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১৯:১৫
রিকশার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে অনেক সুখ-দুঃখের স্মৃতি। অলংকরণ : কিশোর ডাইজেস্ট

রিকশার কথা শোনেনি অথবা রিকশায় চড়েনি, এমন মানুষ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। রিকশার সাথে কমবেশি সকলেই পরিচিত। দৈনন্দিন নানা কাজে রিকশা ব্যবহার হয়ে থাকে। কেউ বা একে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করেন। দেশে স্বল্প আয়ের অনেক মানুষ রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। যদিও শহরে যানজটের অন্যতম কারণ হচ্ছে রিকশা, কিন্তু তা সত্ত্বেও এর প্রচলন কমেনি। এই রিকশাকে ঘিরে অনেকের স্মৃতি, দুঃখ-কষ্ট, ভালোবাসা রয়েছে।

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ২০১৫ সালের একটি প্রকাশনা অনুযায়ী, ঢাকার ৪০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত চলাচলের ক্ষেত্রে রিকশার ওপর নির্ভরশীল। রিকশা বাংলাদেশে বেশি প্রচলিত হলেও এর জন্ম কিন্তু বাংলাদেশে হয়নি। তাহলে কীভাবে এলো এই রিকশা? চলুন জানা যাক এর আদ্যোপান্ত।

রিকশা সর্বপ্রথম চালু হয় জাপানের ইয়োকোহামা শহরে। জোনাথন স্কোবি নামের এক মার্কিন খ্রিস্টান মিশনারি থাকতেন সেখানে। চলনশক্তিহীন স্ত্রীকে শহর ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য স্কোবি দুই চাকার সামনে হাতলবিশিষ্ট বাহনের নকশা আঁকেন এবং কাঠ সেটি দিয়ে তৈরি করেন। সেটিতে করে তাঁর স্ত্রীকে পুরো শহর ঘুরিয়ে দেখান। আর সেখান থেকেই ছড়িয়ে পরে পুরো জাপানে। স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের মাধ্যম হয়ে ওঠে সেটি। এর জনপ্রিয়তা এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে খুব দ্রুতই এটি এশিয়াসহ আরও বিভিন্ন দেশে এর প্রচলন শুরু হয়। এরপর ১৮৮০ সালে রিকশা পৌঁছে যায় ভারতের শিমলায়। ১৯০০ সালে হাতেটানা রিকশা চালু হয় শুধু মালপত্র বহনের জন্য।

জাপানি হাতেটানা রিকশা। ছবি : গেটি ইমেজেস

বাংলাদেশে রিকশা প্রথম আসে চট্টগ্রাম শহরে। কথিত আছে, মিয়ানমারের রেঙ্গুন থেকে চট্টগ্রামে প্রথম রিকশা আসে ১৯১৯ সালের দিকে। এরপর রিকশা আসে ঢাকায়। তবে ঢাকার রিকশা এসেছিল কলকাতা থেকে। ঢাকায় তখন চলত ঘোড়ার গাড়ি, পালকি আর নদীতে নৌকা। নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের ইউরোপীয় পাট ব্যবসায়ীরা ব্যবসার কাজে কলকাতায় যেতেন প্রায়ই। তাঁরাই নিজেদের ব্যবহারের জন্য কলকাতা থেকে ঢাকায় রিকশা আনেন। এভাবে দেশে বাড়তে থাকে রিকশার জনপ্রিয়তা।

কিন্তু বাংলাদেশের রিকশাগুলোর ছিল কিছু ভিন্নতা। দেশজ কুটির শিল্পের মতোই শিল্পীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন চিত্রশিল্পের মাধ্যমে উজ্জ্বল রং এবং তুলির সাহায্যে সেগুলোকে ভিন্নতা প্রদান করেন। রিকশার পেছনে নায়ক-নায়িকার ছবি, ময়ূরের ছবি, বিভিন্ন সিনেমার কাহিনি ইত্যাদির মাধ্যমে রিকশাগুলোকে আর সুন্দর এবং আকর্ষণীয় করে তোলেন। রিকশার পেছনের এই অলংকরণের নাম হলো রিকশাচিত্র। এটিকে চিত্রকলার আলাদা একটি মাত্রা বলা যায়। অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের হাতেই ফুটে ওঠে এই রিকশাচিত্র। নিজস্ব শিল্পশৈলী, উপস্থাপনরীতি ও বিষয়বস্তুর স্বকীয়তার কারণে অনায়াসেই সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে রিকশাচিত্র।

বাংলাদেশে যে প্যাডেল দেওয়া সাইকেল রিকশার প্রচলন, সেটা সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে বলে ইতিহাসবিদ ও গবেষক মুনতাসির মামুনের ‘স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী ঢাকা’ বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। মুনতাসির মামুনের গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, বাংলাদেশে রিকশা এসেছে ১৯৩০-এর দশকে ভারত থেকে।

ইউরোপের অনেক দেশেই রিকশা চলে। ছবি : গেটি ইমেজেস

১৯৪৭ সালের পর থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে রিকশা এবং এর শিল্পধারা জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে।

বিবিসির সূত্রমতে, প্রথম রিকশার মালিক ছিলেন যদু গোপাল দত্ত। প্রথম রিকশা চালকের নাম নরেশ। ঢাকাতে প্রথম রিকশার লাইসেন্স ১৯৪৪ সালের দিকে দেওয়া হয়।

ঢাকায় যানজটের পেছনে রিকশার মতো ধীরগতির যান অন্যতম কারণ বলে অভিযুক্ত করেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। এ কারণে ঢাকার অনেক প্রধান সড়ক থেকে রিকশা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বাহনটির ওপর একটি বিশাল জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল থাকায় রিকশা পুরোপুরি তুলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

রিকশা পেইন্টিং। ছবি : উইকিপিডিয়া

২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ঢাকা শহরের ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’।

সর্বাধিক পঠিত