০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দুই ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর কারিগর যে বাবা

কিশোর ডাইজেস্ট ডেস্ক
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:০৬
সরফরাজ-মুশির খান যেন ভারতের আগামী ক্রিকেটের সেরা হয়ে উঠেন, এ চেষ্টাই নওশাদ খান করেছেন। ছবি: সংগৃহীত

‘বাবা, অর্জুন টেন্ডুলকারের কী সৌভাগ্য! গাড়ি, আইপ্যাড থেকে সব রকম বিলাসিতা আছে ওর জীবনে। তবে কিন্তু আমি ওর চেয়ে সৌভাগ্যবান। কারণ, আমার বাবা পুরো দিনটা আমার সঙ্গে কাটাতে পারে, যেটি অর্জুনের বাবা পারে না।’ বাবা নওশাদ খানকে এই কথাটাই একবার বলেছিলেন সরফরাজ খান। মুম্বাই থেকে বেড়ে ওঠা সরফরাজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার তখনও পূর্ণতা পায়নি।

শুধু সরফরাজ খান নন, তাঁর আরেক ভাই মুশির খানের ক্রিকেটার হয়ে বেড়ে ওঠার প্রতিটি মহূর্তেই যে জড়িয়ে ছিল তাঁদের বাবা। সরফরাজের সাথে বাবা নওশাদের পরিচয় যে শুধু পিতা-পুত্রের গণ্ডিতে আটকে নেই। তিনি একজন কোচ এবং একই সাথে মেন্টরও। নেটে ছেলেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থ্রো-ডাউন করে গেছেন। নিজে একসময় মুম্বাইয়ের হয়ে খেলতেন। কিন্তু ছেলেকে চেয়েছিলেন মুম্বাইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতের জার্সিতে দেখতে। অবশেষে সেই চাওয়া, স্বপ্ন কিংবা অপেক্ষা, সবটাই পূর্ণ হয়েছে। সরফরাজ খানের টেস্ট অভিষেক হয়েছে।

সরফরাজ খানের অভিষেকটাও কী দুর্দান্ত! প্রথম ইনিংসে ৬২, দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ৬৮। ইনিংস ঘোষণা না করলে অভিষেকে সেঞ্চুরিও পেতে পারতেন তিনি। তবে সেঞ্চুরি না পেলেও তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, ক্রিকেট তাঁর আগমন রাজত্ব করার জন্যই। তবে একদিনে তো আর ক্রিকেটার তিনি হননি, এ জন্য বছরের পর বছর তাঁকে ও তাঁর বাবাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে।  

 অভিষেক টেস্টের দিনে বাবা ও স্ত্রীর সঙ্গে সরফরাজ খান। ছবি: সংগৃহীত

ভোরে উঠে প্রতিদিন নেটে বাবার থ্রো-ডাউন, ম্যাচ না থাকলেও নওশাদের সাথে তাঁর ছয় সাত ঘন্টার সেশন, সব কিছুরই একটা ফল পাচ্ছেন সরফরাজ খান। ভারতের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে একটা গল্প লেখার পথে এগিয়েছেন তিনি। যে গল্পের নেপথ্যের নায়ক নওশাদ খান।

বাবাকে আজীবন নায়ক ভেবে আসা ছেলে সরফরাজ খানের প্রতিদান দেওয়া হয়তো অসম্ভবই বটে। তবে নিজের টেস্ট জার্সি নাম্বারেও বাবাকে ধারণ করেছেন তিনি। বাবার জন্যই সরফরাজের জার্সির নম্বর ৯৭। ৯ এবং ৭ এই দুই নম্বরের সঙ্গে সরফরাজের বাবার যোগ রয়েছে। নও মানে নয় আর সাত (৭) আসলে নওশাদের নামের সঙ্গে মিল থাকায় সরফরাজ বেছে নিয়েছেন ৯৭ নম্বর জার্সি।

এবারের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে ৯৭ নম্বর জার্সিতে দেখা গিয়েছে আরো এক ক্রিকেটারকে। তিনি মুশির খান। যিনি নওশাদ খানের আবার কনিষ্ঠ পুত্র। অর্থাৎ সরফরাজ-মুশির সম্পর্কে দুই ভাই। দুই ভাই যেন ভারতের আগামী ক্রিকেটের সেরা হয়ে উঠেন, এ চেষ্টাই নওশাদ করেছেন।  

বাবা নওশাদ খান, দুই ছেলে সরফরাজ-মুশির, গোটা পরিবারটাই যেন এক ক্রিকেট পরিবার। মুশির খান নিজেও এবারের যুব বিশ্বকাপে ছিলেন ভারতের অন্যতম আস্থাভাজন ক্রিকেটার। টুর্নামেন্টে উদয় শাহরনের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৬০ রান এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকেই। একই সাথে দুটি শতকও হাঁকিয়েছিলেন তিনি।

২০২২ এর শেষ দিকে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয়েছিল মুশির খানের। মুম্বাইয়ের হয়ে সৌরাষ্ট্রের বিপক্ষে সে ম্যাচে একসাথে খেলেছিলেন বড় ভাই সরফরাজ খানের সাথেও।

ভারতের সর্বোচ্চ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট লিগে একই সাথে, একই ম্যাচে খেলছে দুই ভাই। মেন্টর কিংবা কোচ হিসেবে বাবা নওশাদ খানের এটাই তো পরম প্রাপ্তি। তবে সেই প্রাপ্তি নিশ্চয়ই ছাড়িয়ে গেছে সরফরাজের টেস্ট অভিষেক কিংবা অনূর্ধ্ব-১ই বিশ্বকাপে মুশির খানের দুটি সেঞ্চুরিতে।

অনূর্ধ্ব-১ই বিশ্বকাপে মুশির খানের হাঁকান দুটি সেঞ্চুরি। ছবি: সংগৃহীত

এক জীবনে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং তারপরও যখন স্বপ্ন পূরণ হয় না, তখন হয়তো পুড়ে যায় অনেকখানি। তবে বাবারা ব্যতিক্রম হয় ঠিক এই জায়গাতেই। দলে সুযোগ না পেয়ে সরফরাজ যখন হতাশায় জর্জরিত, তখন বাবা নওশাদ শুধু তাঁকে নিজের কাজটা করে যেতে বলেছিলেন। সরফরাজ করেছেন। তার সুফলটাও এখন পাচ্ছেন।

একদম নিজ যোগ্যতাবলে সুযোগ পেয়েছেন লাল বলের ক্রিকেটে। অপেক্ষায় ধৈর্যের শেষে এখন শুধু প্রয়োজন সেই স্বপ্নটাকে আরো পরিণত রূপ দিতে। সরফরাজ নিশ্চয়ই সেটা করে যাবেন। কারণ তিনি যে নওশাদ খানের পুত্র।

টেস্ট অভিষেকে বাবার অশ্রু দেখতে পারার সৌভাগ্য কজনই বা দেখতে পারেন। সরফরাজ সেটা দেখেছেন। নিজের প্রথম টেস্টের দুই ফিফটিতে যেভাবে বাবার দিকে ইঙ্গিত করে ‘চুমু’ একেছেন, এমন কিছুর ধারাবাহিকতা নিশ্চয়ই ধরে রাখবেন তিনি।

নওশাদের বড় স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে খেলা। সেই স্বপ্ন পূরণ না হলেও মুম্বাইয়ে ক্লাব ক্রিকেট খেলতেন। রেলওয়েতে চাকরি করতেন। সেসব ছেড়ে লেগে গিয়েছিলেন ক্রিকেট কোচিংয়ে। এরপর তাঁর স্বপ্নে জাতীয় দল থাকল, কেন্দ্রীয় চরিত্র বদলে গেল শুধু। ছয় বছর বয়স থেকেই সরফরাজকে নিয়ে যেতে থাকলেন অনুশীলনে। সরফরাজের জীবনটাও হয়ে গেল যেন ক্রিকেট, ক্রিকেট, শুধুই ক্রিকেট।

সরফরাজ তো এক সাক্ষাৎকারে শুনিয়েছিলেন তাঁর রুটিন, ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠো, ৬টায় রওয়ানা মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দানের উদ্দেশ্যে, ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত নেটে ব্যাটিং। এরপর ম্যাচ, বিকালে আবার ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত নেট, রাত নয়টায় ঘুম। ঘোরাঘুরি, ফুর্তি সেসবের জায়গা ছিলই না বলতে গেলে। সরফরাজ তো একবার বলেছিলেন, মাঝেমধ্যে মিলিটারি জীবন মনে হতো তাঁর।

ধীরে ধীরে সরফরাজের কাছে নওশাদের ‘বাবা’ পরিচয় আড়াল হয়, ‘কোচ’ পরিচয়ই বড় হতে থাকে। সরফরাজ যেমন বলেন, ‘বাবা’কে পাই না, ২৪ ঘণ্টা আমার ‘কোচ’কেই পাই। নওশাদকে নিয়ে আরেকবার বলেছিলেন, তিনি আমার কোচ ৯৭ শতাংশ, বাবা ৩ শতাংশ। ছেলের ক্রিকেট নিয়েই তো নওশাদের সব ধ্যানজ্ঞান ছিল।

কখনো কখনো দিনে তিন সেশন প্র্যাকটিস করতে হতো সরফরাজকে। তখন আজাদ ময়দান থেকে বাসায় যাতায়াতে সময় নষ্ট হবে ট্রাফিক জ্যামে। সেটা ভেবে বাবা নওশাদ মাঠেই ছেলের ঘুমানো ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিতেন। কাপড়-চোপড় সঙ্গে নিয়ে সেখানেই গোসল। এরকমই গ্রীষ্মের দুই মাস ধরে চলত তাঁর রুটিন। ক্রিকেটেই জান-প্রাণ ঢেলে দেওয়া, এই গল্পই তো পুরোটা বুঝিয়ে দেয়।

ঘরের সামনে নওশাদ বানিয়ে ফেলেছিলেন নেট। এস্ট্রোটার্ফের উইকেটে থ্রো-ডাউন করেই যেতেন নওশাদ। আজাদ ময়দান, বাড়ির আঙ্গিনা সবমিলিয়ে ৬০০-৭০০ বল করে খেলতেন সরফরাজ। একবার নওশাদ দেখলেন তাঁর ছেলে সুইংয়ে বলে ভুগছেন। এতদিন ধরে সরফরাজ অনুশীলন করতেন সন্ধ্যার সময়ে, তাই সেরকম সুইংয়ের মুখোমুখি হতেন না। নওশাদ করলেন কী, পরদিন থেকেই সরফরাজের অনুশীলন শুরু করিয়ে দিলেন সাঝ-সকালে সুইংময় কন্ডিশনে।

কোনও রকমের ফাঁকফোকর রাখা যাবে না। বর্ষার দিন, অফ-সিজনে প্র্যাকটিসে সমস্যা? তো কী! চলে যেতেন নওশাদ উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। নওশাদের ছোট ছেলেও ধীরে ধীরে তাঁর স্বপ্নের পরিধিতে ঢুকে যান। ২০২৪ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে যে মুশীর খান ৩৬০ রান করে রানের তালিকায় থেকেছেন দুইয়ে। মুম্বাইয়ের অফ-সিজনে দুই ভাইকে বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে একের পর এক ম্যাচে নামিয়ে দিতেন নওশাদ।

মুম্বাইয়ে নজরে আসতে হলে বড় স্কোরের দরকার। সরফরাজ ১২ বছর বয়সেই বিস্ময়বালক রূপে আগমন করেছিলেন, ৪৩৯ রানের বিশাল ইনিংস খেলে। হ্যারিস শিল্ডে (স্কুল ক্রিকেট) সেই ইনিংস খেলে ভেঙে দিয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের ৩৪৬ রানের রেকর্ড। এরপর বয়সভিত্তিক দলের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ২০১৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের পর ২০১৬ সালেও খেলেছিলেন। সেই ২০১৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পথে ৩৫৫ রান করে রানের তালিকায় ছিলেন দুইয়ে। বড়সড় শিরোনাম তো আদতে হয়েছিলেন মাত্র ১৭ বছর বয়সেই আইপিএলে দল পেয়ে। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে কয়েকটি ইনিংস (২১ বলে অপরাজিত ৪৫, ২১ বলে ৩১) খেলে তখনই নজরে এসেছিলেন।

অবশ্য ২০১৬ সালের আইপিএলের সময়েই বিরাট কোহলি তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ফিটনেসে উন্নতি আনতে হবে নয়তো তুমি খেলতে পারছো না। তরুণ তারকার সাফল্যের বেলুন ধীরে ধীরে চুপসে যেতে থাকল। মাঝখানে মুম্বাই ছেড়ে উত্তর প্রদেশে গিয়েছিলেন। নিয়মিত খেলতে না পেরে সেখানের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। আবার মুম্বাইয়ে এসে এরপর পুনর্জাগরণই যেন ঘটেছে।

শেষ কয়েক বছরে ঘরোয়া ক্রিকেটে এমনই পারফরম্যান্স করেছেন, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভিনদেশেও নজর কেড়েছেন। ২০১৯-২০ মৌসুমে ৯ ম্যাচে রঞ্জি ট্রফিতে করেছিলেন ১৫২ গড়ে ৯২৮ রান। পরের মৌসুমে ৯৮২ রান৷ ২০২২-২৩ রঞ্জিতেও থামেননি ৫৫৬ রানের কমে। এমন গড়ে ব্যাটিং করছিলেন, প্রথম শ্রেণীতে ডন ব্রাডম্যানের পেছনেই একটা সময়ে ছিলেন। কিন্তু এত এত পারফরম্যান্স, তবু সুযোগ মিলছে কই!

সরফরাজের স্বপ্ন ছিল, বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় অন্তত একবার হলেও যেন ভারতের জার্সিটা তাঁর গায়ে উঠে। সেই স্বপ্ন রাজকোটে সত্যি হওয়ার পর সরফরাজের মনে হল, একটা বোঝা যেন পিঠ থেকে সরে গেল।

নওশাদ খান না থাকলে যে কিছুই হতো না সরফরাজ খানের। তিনি বলেন, ‘জীবনভর মাঠে আমাকে নিয়ে কষ্ট করেছেন। দিনভর দৌড়ে চলেছেন এদিকে, ওদিকে। কখনো তো আমার নিজের কাছেও লাগত, কেন করছেন এসব? আর বাদ দিয়ে দেওয়া উচিত। জীবনে কতবার মনে হয়েছে, আমি শেষ। কিন্তু আব্বু আমাকে শেষ হতে দেননি। যদি তিনি থাকতেন না, তাহলে কে জানে আমার কী হতো!’

একটিবার ভারতের জার্সি গায়ে নেমে বাবাকে দেখানো, সরফরাজের সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। বলা যায়, রাজকোট টেস্ট ছিল বাবার নামেই। অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাদবাকি পথচলায়ও বাবা থাকবেন তাঁর সঙ্গে, সেই ৯৭ সংখ্যার ভেতরেই।

সর্বাধিক পঠিত