ক্লাস টুতে ভর্তি পরীক্ষার কোচিং করতাম ফারহান ফাইয়াজের সঙ্গে। একসঙ্গে ভর্তি হলাম ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে। আমি দিবা শাখায়, আর প্রভাতিতে ফারহান। আমাদের ভালো বন্ধুত্ব হয় ২০২১ সালে। তখন আবার একসঙ্গে কোচিং করতাম। কোচিংয়ের আগে-পরে আড্ডা জমে উঠত। গল্প করতে করতে কখন যে রাত আটটা-নয়টা বেজে যেত, টেরও পেতাম না।
ফ্যাশনের দিক দিয়ে ফারহান একটু আলাদা ছিল। একেক সময়ের একেক স্টাইল আমাদের তাক লাগিয়ে দিত। পোশাক থেকে শুরু করে চুল-দাড়ির স্টাইলও ছিল আলাদা। মাঝেমধ্যে আমার কাছে এসে বলত, ‘মামা দ্যাখ, আমি কালো হয়ে গেছি না?’ এসব কারণে বন্ধুদের কাছে ওর ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল ‘ধলা’। সবাই মজা করে ‘ধলা’ বলে ডাকত। সব সময় ওর মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করতাম। কলেজের বিভিন্ন ক্লাবেও ওর নামডাক ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমেও ছিল সরব।
২০২১-এর পর থেকে ওর সঙ্গে আমার হাজারো স্মৃতি আছে। কখনো কখনো কোচিং ফাঁকি দিয়ে চুপি চুপি ঘুরেও বেরিয়েছি। একদিন রাতে আমাকে জোর করে ধরল, চাঁদ দেখাবে। কলেজের একটা ফেস্টে টেলিস্কোপ আনা হয়েছিল চাঁদ দেখানোর জন্য। সেখানে স্বেচ্ছাসেবক ছিল ফারহান। কোচিং বাদ দিয়ে ওর সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম চাঁদ দেখতে। আরও কত কী!
একবার একসঙ্গে অনেকজন মিলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। বসুন্ধরার টগি ফান ওয়ার্ল্ডেও গিয়েছিলাম। মাঝেমধ্যেই বলত, ‘চল মামা এখানে যাই, চল ওখানে যাই।’ কত জায়গাতেই না যাওয়া বাকি ছিল আমাদের!
ফারহানের খুব ইচ্ছা ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চায়, এমনটাও বলত কখনো কখনো। মাঝেমধ্যেই পড়াশোনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করত আমার সঙ্গে। মানুষ হিসেবে ছিল খুব নম্র, ভদ্র। সিনিয়রদের শ্রদ্ধা, জুনিয়রদের স্নেহ করত। জুনিয়রদের কাছে ওর বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। শুধু আমাদের কলেজেই নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও নামডাক ছিল। কয়েক দিন আগে টেন মিনিট স্কুলের এক প্রতিযোগিতায় সে আমাদের কলেজের প্রতিনিধিত্ব করেছিল।
আমাদের শেষ দেখা হয় গত ১৫ জুলাই, দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার পর। একসঙ্গে গল্প করতে করতেই সেদিন বাসায় গিয়েছিলাম। ১৬ তারিখে কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমি গিয়েছিলাম। আমার এক পোস্টে ফারহান মন্তব্যের ঘরে লিখেছিল ‘প্রাউড অব ইউ।’কে জানত, সে-ই আমাদের সবাইকে ‘প্রাউড’ করে চলে যাবে।
১৮ তারিখ আমাদের কলেজের অনেক শিক্ষার্থী আন্দোলনে অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ফারহানও ছিল। দুপুরেও আমাদের কিছু শিক্ষক রাস্তায় ওকে দেখেছেন। বেলা তিনটার দিকে রাবার বুলেট এসে লাগে ফারহানের বুকে ও মুখে। সেদিন আমি বাসায় মুঠোফোন নিয়ে বসে ছিলাম, সবার খোঁজ নিচ্ছিলাম। একজন মেসেজে বলল, ফারহান গুরুতর আহত। এরপরই ভিডিওতে দেখলাম, ওকে ধরে রিকশায় তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখনো বুঝতে পারিনি এত খারাপ অবস্থা। পরে যখন জানলাম আমাদের ফারহান আর নেই, প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। পরে ছবি দেখে আর থাকতে পারিনি। কেউই থাকতে পারেনি। প্রত্যেক রেমিয়ানের (রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী) চোখ ভিজে এসেছে। সেই বৈরী পরিস্থিতিতেও কলেজের মাঠে প্রায় ২০০ মানুষ জানাজা পড়ার জন্য এক হয়েছিলেন। কে, কাকে, কী বোঝাব? বিরাট এক ময়দানে যেন কান্নার ঢল নেমেছিল। আমরা কেউ ফারহানকে ভুলতে পারব না। ও আমাদের সবার মধ্যে মিশে থাকবে।
লেখক: কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত ফারহানের বন্ধু, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র।