গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজকে পুলিশ যখন রিকশার পাদানিতে তুলে দেয়, তখনো সে রিকশার রডটি হাত দিয়ে ধরে রেখেছিল। রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ তাকে নিয়ে রাজধানীর ফার্মগেটের একটি হাসপাতালে ঢুকতে গেলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বাধা দেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক। পরে ১৭ বছরের গোলাম নাফিজকে নিয়ে রিকশাচালক খামারবাড়ির দিকে চলে যান।
দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বাধার পরও রিকশার পাদানিতে ঝুলতে থাকা নাফিজের কয়েকটি ছবি তুলতে পেরেছিলেন। ৪ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টার পর পত্রিকাটির প্রথম পাতায় ছাপা নাফিজের একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ছবি দেখেই নাফিজের মা-বাবা সন্তানের খোঁজ পান।
এখন মা–বাবা আর ওই ফটোসাংবাদিকের আক্ষেপ, যদি দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া যেত আর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো ছেলেটিকে বাঁচানো সম্ভব হতো।
গোলাম নাফিজ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষে গুলিতে মারা যায়। সে রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করে কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। পরিবারসহ থাকত মহাখালীতে। দুই ভাই তারা। নাফিজ ছোট।
সম্প্রতি নাফিজের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাসায় নাফিজের ঘরে একটি বড় ব্যানার টানানো আছে। বনানী বিদ্যানিকেতনের বানানো এই ব্যানারে রিকশার পাদানিতে মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা রক্তাক্ত নাফিজের ছবির পাশেই তার আগের একটি হাসিমুখের ছবি দেওয়া আছে।
নাফিজের বড় ভাইয়ের নাম গোলাম রাসেল। এইচএসসি পাস করে এখন তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। নাফিজ বড় ভাইয়ের বই দিয়ে নিজের পড়ার টেবিলটি সাজিয়ে রেখেছিল। কলেজের নতুন পোশাক (ইউনিফর্ম) বানানোর পাশাপাশি শীতের সময় পরার জন্য পছন্দ করে সোয়েটার কিনেছিল। এখন সেসব ঘরে পড়ে আছে।
নাফিজের বাবা গোলাম রহমান ও মা নাজমা আক্তার। নাফিজের ঘরে বসে তাঁরা একটি প্যাকেট থেকে একে একে ছেলের কলেজের নতুন পোশাক, ছোটবেলার নীল রঙের একটি বল আর রিমোটচালিত খেলনা গাড়ি বের করে দেখালেন। বললেন, ‘ছেলে কলেজে পড়লেও এগুলো দিয়ে খেলত। স্কুলে বিতর্ক করত।’
রিকশার পাদানিতে সন্তানের রক্তাক্ত শরীরের ছবি দেখিয়ে পেশায় ব্যবসায়ী গোলাম রহমান বলেন, ‘ওই যে দেখেন, ছেলেটা রিকশার রডটা ধইরা রাখছিল। কত খুঁজলাম, তখন যদি ছেলেটারে পাইতাম, বাঁচানোর জন্য একটু চেষ্টা করতে পারতাম। ছেলের বুকের মধ্যে লাগা গুলি পিঠের দিক দিয়া বাইর হইয়া যায়। পরে তো শুনি আমার চাঁদের মতো ছেলেটা মর্গে আছে।’
নাফিজের পরিবারের সদস্য, বন্ধুসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্দোলন করতে গিয়ে ৪ আগস্ট বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফার্মগেটের পদচারী–সেতুর নিচে নাফিজ গুলিবিদ্ধ হয়। নাফিজ নিজের মুঠোফোন বাসায় রেখে গিয়েছিল। তিনটার দিকে এক বন্ধুর মুঠোফোন থেকে মাকে ফোন করে বলেছিল, ফার্মগেটের দিকে আছে সে। ভালো আছে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে।
গোলাম রহমান জানান, ওই দিন রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ছেলেকে খুঁজতে বের হয়েছিলেন তিনি। কয়েকবার পুলিশি বাধার মুখেও পড়েন। ফার্মগেট আর সোনারগাঁও মোড়ে কয়েকবার ঘুরে আসেন। বিভিন্ন থানায় খোঁজ নেন। ভেবেছিলেন, ছেলেকে হয়তো আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে। না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও খুঁজতে যান।
গোলাম রহমান বলেন, ‘কোথাও না পেয়ে রাত ১২টা নাগাদ বাসায় ফিরি। এরপরই বড় ছেলে মানবজমিনে ছাপা হওয়া ছবিটা দেখায়। বুঝতে পারি, ছেলেটা হয়তো ততক্ষণে আর বেঁচে নাই। বিভিন্ন হাসপাতালে ছেলেকে খুঁজতে শুরু করি।’
গোলাম রহমান বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলের মর্গে ২৭টি লাশ। আমরা তো লাশ দেইখ্যা অভ্যস্ত না। তারপরও দেখি যদি ছেলেরে পাই। মানবজমিনের ছবিটা দেখার পর বুঝতে পারি ছেলে মারা গেছে। তবে যে করেই হোক ছেলের লাশটা পাইতে হবে। মন তো মানে না।’
ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার ঘরে। নাফিসের মামা আবুল হাসেম ফোন করে গোলাম রহমানকে জানান, নাফিজের লাশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আছে। লাশ আনার পর নিজেই ছেলেকে গোসল করান তিনি। বলেন, ‘ছেলের লাশ নিজেই গোসল করাই। কী যে কষ্ট।’
গোলাম রহমানের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন নাফিজের কয়েকজন বন্ধু সেখানে ছিল। ওরা নাফিজের সঙ্গে ৪ আগস্ট ঘটনাস্থলে ছিল। জানাল, গোলাগুলি শুরু হলে তারা বাসায় চলে যেতে পারলেও নাফিজ আর যেতে পারেনি। গোলাম রহমান খাতা–কলম নিয়ে সময় ধরে ধরে সেদিনের ঘটনার কথা জানতে চাচ্ছিলেন ছেলের বন্ধুদের কাছে। বললেন, ছক করে দেখতে চাচ্ছেন আসলে তিনি কোনোভাবে ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারতেন কি না।
এখন ছেলে হত্যার বিচার চান শোকার্ত এই বাবা। তিনি চান, ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, তাই সে যেন জাতীয় বীরের সম্মান পায়।
ছেলে পেছন থেকে এসে আর জড়িয়ে ধরবে না—এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নাফিজের মা নাজমা আক্তার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, নাফিজ বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে যাচ্ছে এটা পরিবারের সবাই জানতেন। তবে ৪ আগস্ট পরিস্থিতি খারাপ বলে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু ছেলে যখন যাবেই, তখন সাবধানে থাকতে বলেছিলেন।
একটু সামলে নিয়ে নাজমা আক্তার বলেন, ‘নিজেই চাইতাম আন্দোলনে ছাত্ররা জিতুক। নামাজ পড়ে দোয়া করতাম আর কোনো মায়ের বুক যাতে খালি না হয়। ছেলের মোবাইলে আন্দোলনের অনেক ছবি ছিল। নিরাপত্তার জন্য ছবি ডিলিট করতে বলায় ছেলে আমার সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই ছেলে আমারে দেশ দিয়ে গেছে। আমি আওয়ামী লীগ-বিএনপি বুঝি না, আমি শুধু চাই, দেশে শান্তি আসুক।’
কথা হলো ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের সঙ্গেও। তিনি বললেন, ছেলেটাকে যদি হাসপাতাল পর্যন্ত নিতে পারতেন, তাহলে হয়তো বাঁচত—এটাই তাঁর আক্ষেপ। তবে তাঁর তোলা ছবি দেখে মা–বাবা তাঁদের সন্তানের লাশ খুঁজে পেয়েছেন, এটা ভেবে একটু সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাধার মুখে নাফিজকে ফার্মগেটের হাসপাতালে নিতে পারেননি বলে জানান তিনি।
জীবন আহমেদের তোলা সেই ছবিতে রিকশার পেছনে একটি মুঠোফোন নম্বর দেখা গেছে। ওই নম্বরে ফোন দিয়ে রিকশাচালক নূর মোহাম্মদকে খুঁজে বের করেন নাফিজের পরিবারের সদস্যরা।
রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ বলেন, রিকশা তাঁর নিজের। ওই দিন ফার্মগেটে ‘গ্যাঞ্জামের’ মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন এক পুলিশ তাঁকে ডেকে নিয়ে গেলে অন্যরা তাঁর রিকশায় একজনকে তুলে দেন। তিনি প্রথমে ফার্মগেটের একটি হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে বাধার মুখে সেখানে ঢুকতে পারেননি। পরে খামারবাড়িতে গেলে কয়েকজন নাফিজকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে বলে একটি অটোরিকশায় তুলে নিয়ে চলে যান।
৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরখানে নাফিজকে কবর দেওয়া হয়। সে ছোটবেলা থেকেই স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি স্কাউট, বিএনসিসি কার্যক্রমে সক্রিয় ছিল। নাফিজ শিখো-প্রথম আলো জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছিল। সে ক্রেস্ট, সনদ আর নাফিজের পছন্দের ঘড়িসহ অন্যান্য জিনিসে হাত বুলিয়ে দেখছিলেন মা–বাবা।
বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ জানালেন, বিদ্যালয়ের মিলনায়তনের নাম নাফিজের নামে রাখার প্রস্তাব করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
নাফিজের বড় ভাই গোলাম রাসেল বললেন, ‘টিকটক জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা আন্দোলন করেছে, জীবন দিয়েছে। তারা ঠিক যে রকম একটি দেশ চেয়েছিল, ঠিক সেই রকম একটি দেশ চাই।’
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, মানবজমিন