০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

যেমন ছিল ইলন মাস্কের কৈশোর

কিশোর ডাইজেস্ট ডেস্ক
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২০:৫২
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় ভাই ও কাজিনদের সঙ্গে মাস্ক। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক। তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ১৯৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি শুধু একজন সফল উদ্যোক্তাই নন, সফল উদ্ভাবকও। পেপ্যাল, স্পেসএক্স, টেসলা এবং টুইটারের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার আগে ছোটবেলা থেকেই মাস্কের জীবন ছিল নানা ঘটনায় পরিপূর্ণ। নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশা তাঁর খুব ছোটবেলা থেকেই। অল্প বয়সে নিজে নিজেই কোডিং করে ভিডিও গেম তৈরি করেছেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক, যেমন ছিল ইলন মাস্কের শৈশব-কৈশোর।

ইলন রিভ মাস্ক ১৯৭১ সালের ২৮ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ইরোল মাস্ক ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান, কিন্তু মা মেই মাস্ক ছিলেন কানাডিয়ান। ইলন মাস্কের ছেলেবেলা কাটে তাঁর ভাই কিম্বাল এবং বোন টোসকার সাথে। তাঁর শৈশব-কৈশোরের অধিকাংশ সময়ই কাটে দক্ষিণ আফ্রিকায়। পরে অবশ্য তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গে চলে আসেন কানাডায়।

বিজনেস ইনসাইডারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছোটবেলায় মাস্ক খুব সহজে কারও সঙ্গে মিশতে পারতেন না। সমবয়সী অনেকেই খেলতে নিত না। বিষয়টি কেবল খেলতে না নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। স্কুলজীবনে একাধিকবার বিদ্রূপ, অপমান ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাস্ক তাঁর সহপাঠীদের হাতে বেশ কয়েকবার মারধরের শিকার হয়েছেন। একবার তো তাঁকে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘ইলন মাস্ক : টেসলা, স্পেসএক্স, অ্যান্ড দ্য কোয়েস্ট ফর আ ফ্যান্টাস্টিক ফিউচার’ বইয়ের জন্য দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাস্ক জানান, ছেলেদের গ্যাং তাঁকে তাড়া করত এবং একবার মেরে তাঁকে সিঁড়িতে ফেলে দিয়েছিল। এই ঘটনায় হাসপাতালেও যেতে হয়েছিল মাস্ককে। শৈশব সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে—আমার শৈশব মোটেও সুখের ছিল না।’

তিন বছর বয়সে খেলনা গাড়ি নিয়ে মাস্ক। ছবি: মেই মাস্কের সৌজন্যে

এ জন্য ছোটবেলা থেকেই মাস্ক সবার থেকে আলাদা হয়ে নিজের জগৎ তৈরি করে নিয়েছিলেন। ছিলেন বইয়ের পোকা। মাস্কের মতে, ‘আমি বইয়ের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। প্রথমে বই, তারপর আমার মা-বাবার কাছ থেকে শিখেছি।’

মাত্র ৯ বছর বয়সে পুরো এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা পড়া শেষ করেছিলেন মাস্ক। সায়েন্স ফিকশন, কমিকস এবং নন-ফিকশন বইয়ের পেছনে দিনে অধিকাংশ সময় ব্যয় করতেন তিনি। মাস্কের বাবা-মা যখন বাসায় থাকতেন না, তখন তিনি বাসার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে থাকতেন। মাস্ক জানান, তিনি যাতে বাসার কিছু নষ্ট না করেন, সেদিকে লক্ষ রাখতেন ওই নারী।

মাস্ক বলেন, ‘তিনি আমাকে নিয়ে পড়ে থাকতেন না। আমি নিজে নিজে বিস্ফোরক তৈরি করতাম, বই পড়তাম, রকেট বানাতাম এবং আরও অন্যান্য জিনিস করতাম, একটু এদিক-সেদিক হলে যেগুলো আমার জীবন নিতে পারত। আমার সবগুলো আঙুল অক্ষত আছে দেখে আমি এখনও বিস্মিত।’

ছোটবেলায় মাস্ক কোনও কিছু নিয়ে এতটাই গভীর মনেযাযোগে ডুবে থাকতেন যে তাঁর বাবা-মা চিন্তায় পড়ে যান, তিনি বধির কি না, তা জানার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্নও হয়েছিলেন। পরে অবশ্য তাঁর মা বুঝতে পেরেছিলেন যে এটি তাঁর নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার উপায়।

১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় ইলন, তোসকা, কিম্বাল (বাম থেকে ডানে)। ছবি: মেই মাস্কের সৌজন্যে

মাস্কের মা মেই বলেন, ‘সে যখন কোনও কিছু নিয়ে ভাবে, তখন দেখবেন সে ভিন্ন জগতে চলে গেছে। সে এখনও এই কাজ করে। এখন আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করি না। কারণ, আমি জানি সে হয়তো নতুন রকেট বা অন্য কিছু নিয়ে ভাবে।’

কম্পিউটার কোডিংয়ের শুরুর দিনগুলোতে মাস্ক ‘ব্লাস্টার’ নামের একটি ভিডিও গেমের কোডিং করেন। এটা ছিল একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি-ভিত্তিক গেম। পৃথিবীকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আসা এলিয়েন স্পেসক্রাফটকে ধ্বংস করাই ছিল ব্লাস্টের উদ্দেশ্য। গেমটির সোর্স কোড দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রকাশনা সংস্থার কাছে ৫০০ ডলারে বিক্রি করে দেন তিনি।

সেখানেই থেমে থাকেননি মাস্ক। উদ্যোক্তা হওয়ার প্রমাণ তিনি রেখেছেন ১৬ বছর বয়সেই। তাঁর মা মেই মাস্ক বলেন, ‘সে তাঁর কল্পনায়ই অনেক কিছু তৈরি করে ফেলতে পারত এবং পরে সে অনুসারে কিছু করার চেষ্টাও করত।’ মাস্কের ঊর্বর মস্তিষ্ক থেকে আইডিয়া আসে একটি ‘ভিডিও আর্কেড’ তৈরি করার।

মাস্ক তাঁর ভাই কিম্বালকে নিয়ে বাসার পাশেই ভিডিও আর্কেড প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। অফিস ভাড়া নেওয়ার জন্য শহর কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ফরম পূরণ করেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শহর কর্তৃপক্ষ জানায়, অফিস ভাড়া নেওয়ার মতো উপযুক্ত বয়স তাঁদের হয়নি। এ জন্য তাঁদের এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।

এ ঘটনার বছরখানেকের মধ্যেই ইলন মাস্ক ১৭ বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কানাডায় চলে আসেন। মাস্ক পরে স্টারটক রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কানাডায় চলে আসাই তাঁর জীবনকে বদলে দিয়েছিল। এই সময়টাতে তাঁকে সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়েছে। সে সময় সারা দিনে মাত্র ১ ডলার পেতেন। সেই ১ ডলারের বিনিময়ে ইলন মাস্ক কেবল খাবারই কিনতে পারতেন, আর কিছু নয়। সেটিও বিভিন্ন সুপার মার্কেটের প্রায় মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া খাবার—যেগুলো ফেলে দেওয়ার জন্য স্তূপ করে রাখা হতো।

কৈশোরে তিন ভাই-বোন। কিম্বাল, তোসকা, ইলন (বাম থেকে ডানে)। ছবি: মেই মাস্কের সৌজন্যে

একপর্যায়ে ইলন মাস্ক বাধ্য হয়ে নিজের আয় বাড়াতে বড়লোকদের দুয়ারে হানা দিতে শুরু করেন নিজেদের তৈরি চকলেট ইস্টার এগস বিক্রির জন্য। সঙ্গে বিক্রি করতেন ক্যান্ডিও। ইস্টার এগগুলো ইলন মাস্ক ও তাঁর ভাই কিম্বাল মিলে বানাতেন। তাঁরা যে দামে বানাতেন তার চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি দামে বিক্রি করতেন।

২০১৭ সালে সিএনবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কিম্বাল বলেছিলেন, ‘একটি ইস্টার এগ বানাতে আমার খরচ হতো ৫০ সেন্ট, কিন্তু বিক্রি করতাম ১০ ডলারে। সবাই আমাকে শুধু জিজ্ঞেস করত কেন একটি ইস্টার এগ ১০ ডলারে বিক্রি করছি! জবাবে আমি বলতাম, আপনারা একজন তরুণ উদ্যোক্তাকে সহায়তা করছেন। আমার কাছে ছাড়া এটি আর কোথাও পাবেন না। আর আপনারা জানেন ১০ ডলার খরচ করার সামর্থ্য আছে আপনাদের।’

এমন অনেক ঘটনা রয়েছে ইলন মাস্কের জীবনে। এসব ঘটনাই তাঁর জীবন বদলে দিয়েছে। যেমন, মাস্ক এবং তাঁর ভাই যদি ভিডিও আর্কেডের অনুমতি পেয়ে যেতেন তবে কি বিশ্ব টেসলা এবং স্পেসএক্স দেখতে পেত? হয়তো পেত কিংবা পেত না। তবে মাস্কের শৈশব যে এক বিভীষিকাময় ছিল তা স্পষ্ট। বলা হয়, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই হেটারদের দেখিয়ে দেওয়ার জেদ চেপে বসেছিল তাঁর হৃদয়ে। তিনি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, এ কথা তো বলাই যায়।

সর্বাধিক পঠিত