০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সাক্ষাৎকার : মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ধনী-গরিবের সন্তান যেন সমান সুযোগ নিয়ে বড় হতে পারে

মাজহার সরকার
২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:৪৯
কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল। অলংকরণ : কিশোর ডাইজেস্ট

শিশু-কিশোরদের কাছে অন্যতম প্রিয় লেখক কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তাঁর অনেক রচনাই বাংলা কিশোর-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। কয়েকটি উপন্যাস থেকে নির্মিত হয়েছে সফল চলচ্চিত্রও। তিনি কলামিস্ট হিসেবেও জনপ্রিয়। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও কথাসাহিত্যিক মাজহার সরকার

আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কীভাবে কেটেছে?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : আমার শৈশব বাংলাদেশের অনেক জায়গায় কেটেছে আসলে। আমার বাবা (বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ফয়জুর রহমান) পুলিশে চাকরি করতেন, শুরু হয়েছে সিলেট থেকে। সেখান থেকে গিয়েছি পঞ্চগড়, তারপর রাঙামাটি, সেখান থেকে বান্দরবান, চট্টগ্রাম, বগুড়া, কুমিল্লা, পিরোজপুর। ১৯৭১-এর পর ঢাকা। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে।

আপনার স্কুল জীবনের স্মৃতি বলবেন? কোনও শিক্ষক আছেন কি যাঁর কথা এখনও মনে পড়ে, বেঞ্চে বসে যাঁর ক্লাস করতে ইচ্ছা করে?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : তখন তো ছোট্ট ছিলাম। এই ছোট্ট বাচ্চারা স্কুল পছন্দ করে না সেভাবে। আমিও যে স্কুল পছন্দ করতাম না তা নয়। তবে হ্যাঁ, এখনও মনে আছে বগুড়া জিলা স্কুলে কিছু শিক্ষক ছিলেন, খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন তাঁরা।

আপনার বইপড়া কখন কীভাবে শুরু?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : আমার বাবার বই নিয়ে খুব আগ্রহ ছিল। বাসাভর্তি অনেক বই ছিল। আমার জন্মের পর থেকে বলতে গেলে শুধু আমি নই, আমার ভাইবোন সবাই বইয়ের জগতে বসবাস করেছি। শৈশব পুরোটা বই পড়ে পড়ে কেটেছে।

পিথাগোরাসের একটি কথা আছে, ‘শিশুদের সুশিক্ষা দাও, তাহলে আর বড়দের শাসন করার প্রয়োজন পড়বে না।’ দেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই শিশু, কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষখাতে ব্যয় করার সুপারিশ আছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো)। আনফরচুনেটলি আমাদের দেশে শিক্ষাখাতকে আমলে নেওয়া হয় না। এ খাতে ব্যয় কমতে কমতে এখন ২ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। এত কম বরাদ্দে তো লেখাপড়া হওয়ার কথা নয়। শিক্ষাখাতে এত কম খরচ মনে হয় না পৃথিবীর আর কোনও দেশে আছে। তারপরও যেটুকু হচ্ছে আমি মনে করি শিক্ষাখাত ভালো আছে। এ বিষয়ে আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি, কথা বলেছি। কিন্তু সরকার এটাকে কখনও গুরুত্ব সহকারে দেখেনি। তো ওভাবে রয়ে গেছে।

আপনার লেখালেখিতে আগ্রহের বড় একটা জায়গা ‘মুক্তিযুদ্ধ’। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তবাক এবং মুক্তমনের কথা। কেবল পাঠ্যপুস্তকের সূচি সংযোজন-বিয়োজন কিংবা সিলেবাস প্রণয়ন করে কি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শিশু-কিশোরদের দায়বদ্ধ করা যাবে?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : মুক্তিযুদ্ধ আমাদের একটা অর্জনের ইতিহাস। কারণ, আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এত বড় অর্জন আমার মনে হয় না ইতিহাসে আরেকটা আছে। একইসঙ্গে এটা বীরত্বের ইতিহাস, যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা একেবারেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তারপরও তাঁরা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। এটা ত্যাগের ইতিহাস। এত মানুষ মারা গিয়েছিল যুদ্ধের সময় যে প্রত্যেকটা পরিবার থেকে কেউ না কেউ হারিয়ে গিয়েছিল। এই ইতিহাস যদি শিশু-কিশোররা জানে তাহলে তারা নিজের দেশকে ভালোবাসবে। ওরা যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা জানে, সেজন্য আমি নিজের মতো করে চেষ্টা করি, মুক্তিযুদ্ধের ওপর বই লিখি। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি যখন যেভাবে পারি। মাঝখানে একটা দুঃসময় এসেছিল। সে সময় মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীরা মন্ত্রী হয়েছিল। আমরা সেই দুঃসময়টা পার করে এসেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছি, এখন মনে হয় যে আমরা স্বাধীন। একটু সতর্ক থাকতে হবে যেন আবার কখনও এই ধরনের বিপদে না পড়ি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভুলে না যাই।

শিশু-কিশোরদের জীবনের নানা লক্ষ্য থাকে—কেউ চিকিৎসক হবে, প্রকৌশলী হবে, কেউ বিজ্ঞানী হবে ইত্যাদি। কিন্তু কেউ দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখে, এমনটা শোনা যায় না। বড় হয়ে রাজনীতিবিদ হওয়ার ইচ্ছে কেউ পোষণ করে না। কেন করে না?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে কেবল একজন প্রধানমন্ত্রী হয়। এটা তো জানা কথা, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি মনে করি, অনেক শিশু আছে যারা মনে করে যে দেশকে ভালোবেসে দেশের কর্ণধার হবে। এটা অন্যায় ইচ্ছে নয়। কেউ বড় হয়ে রাজনীতি করে যদি প্রধানমন্ত্রী হতে পারে, কোনও বাধা নেই তো! তবে বাবা-মা হিসেবে যদি সন্তানকে বলি ‘তোমাকে বড় হয়ে প্রধানমন্ত্রী হতেই হবে’, এটা ঠিক নয়। তাকে বলতে হবে যে, তুমি বড় হয়ে রাজনীতি করে দেশের জন্য কাজ করবে, প্রধানমন্ত্রী না হয়েও দেশের জন্য কাজ করা যায়।

হেইজারের একটা কথা আছে এমন, ‘ফুল যখন ফুটতে পারে না আমরা তখন ফুল মেরামত করি না। ফুল যেখানে ফুটবে সেই পরিবেশটার যত্ন নিই।’ শিশু-কিশোরদের বিকাশে আমাদের কেমন পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : একটা ছোট্ট বাচ্চার জীবন আমার মতো হবে না। তাদের চাপ দিয়ে লাভ নেই। সবাই ডাক্তার হবে না, সবাই ইঞ্জিনিয়ার হবে না। অনেকে শিল্পী হবে গান গাইবে, অনেকে ক্রিকেট খেলবে, অনেকে ফুটবল খেলবে। কাজেই শিশু যেটা ভালো পারে তাকে সেটা করতে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমাদের দেশে জিপিএ ফাইভের যে একটা চাপ আছে, এগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ওদের মতো করে ওরা বড় হোক। বাবা-মায়ের দায়িত্ব হচ্ছে শিশুদের ভালো মানুষ হিসেবে বড় করা। তারপর শিশু তার নিজের জীবন নিজেই তৈরি করে নিতে পারবে।

দৈনন্দিন জীবনে এবং শিশুসাহিত্যে বাস্তব জগতের অনেক ঘটনা আমরা আড়াল করি। কিন্তু এই শিশুরাই যখন পরবর্তী জীবনে ঢোকে, তখন তারা মিল খুঁজে পায় না। পৃথিবী যদি অসরলই হয়ে থাকে, তাহলে আমরা কেন শিশুসাহিত্যে ‘সরলতা’ সাজিয়ে দেখাই?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : শিশুরা সব বোঝে, ওরা চারপাশ দেখে। অনেক বাবা-মা মুখে বলে খুব ভালো, কিন্তু নিজেরা অসৎ। শিশুরা কিন্তু ঠিকই বোঝে, মনে কষ্ট পায়। শিশুরা ‘কিছুই বোঝে না’ এমনটা মনে করা ঠিক নয়, ওদেরও একটা বিবেক আছে, চোখ আছে, বুদ্ধিমত্তা আছে। ওদের স্বাভাবিকভাবে বড় হতে দেওয়া হোক। বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। প্রচুর বই পড়লেই ওরা জেনে যাবে সব, যা যা জানা দরকার। শিশুদের কখনও আন্ডারস্টিমেট যেন না করি। আমি শিশুদের বড় মানুষের মতো ট্রিট করি, আমি জানি তাদের চোখ খোলা আছে, সে সবকিছু দেখছে। আগে হোক পরে হোক সে এটা জেনে যাচ্ছে। শিশুদের ছোট্ট মানুষ ভাবার কোনও কারণ নেই, শিশুরাই বড়।

আপনার কোনও স্বপ্ন আছে, যা পূরণ করতে চান?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : নিজের জীবনটাই তো স্বপ্ন আসলে। শিশুদের পড়াশোনা যেন আনন্দময় হয়, কোনও চাপ যেন না হয়। যেটা ভালো লাগে সে যেন সেটা করার সুযোগ পায়। স্বপ্ন দেখি দেশের অর্থনীতি আরও ভালো হবে, কোনও বৈষম্য থাকবে না। ধনীর ছেলে আর গরিবের ছেলে যেন একই সুযোগ নিয়ে বড় হতে পারে—এটাই আমার স্বপ্ন।

অভিভাবকদের প্রতি আপনার বিশেষ কিছু বলার আছে কি?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : একটা কথা বলার আছে। সব সময় বলি যে, আমরা খুব ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। প্রযুক্তি চলে এসেছে, কিন্তু এর ব্যবহার জানতে হবে। প্রযুক্তি যদি আমাকে দখল করে নেয়, যদি আমরা প্রযুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হই, সেটা খুবই দুঃখের বিষয় হবে। আমি চাই সবাই বই পড়ুক, যারা বই পড়বে তারা এই প্রযুক্তির হাত থেকে মুক্ত হতে পারবে। অসংখ্য ভালো বই আছে, যদি তারা বই পড়ে তবে তারা সত্যিকার মানুষ হবে। আমার অনুরোধ, সবাই যেন নিয়ম করে বই পড়ে।

সর্বাধিক পঠিত