০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
বই আলোচনা

কিশোরদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বই ‘একাত্তরের চিঠি’

মাহাথির আরাফাত
২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:৪৯
কিশোরদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বই ‘একাত্তরের চিঠি’। অলংকরণ : কিশোর ডাইজেস্ট

তুমি কখনও চিঠি লিখেছ কাউকে? সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে ঝকঝকে একখানা চিঠি! যেখানে থাকবে তোমার মনের কথাগুলো, থাকবে কারো জন্য স্নেহ-ভালোবাসা, সম্মান আর কড়া আদেশ। না না, পরীক্ষায় নাম্বার পাওয়ার জন্য যে চিঠি লিখো, ওগুলোর কথা বলছি না। একদম সরাসরি বাস্তব চিঠি লিখেছ কখনও? পোস্ট অফিসে গিয়েছ? একটা চিঠি পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহ আর অপেক্ষায় থেকেছ কখনও? জানি জানি, আমার এসব বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে সবাই নাক উঁচিয়ে বলবে, অ্যাঁ, আজ আর কেউ চিঠি লিখে নাকি? এখন তো মেসেঞ্জার, হোয়াটস-অ্যাপ, ইমো আর স্কাইপের যুগ। হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। এখন কেউ চিঠি লিখে না।

এবার ভাবো তো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা। তখন কি তোমাদের এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর পদ্ধতি ছিল? ছিল কি মোবাইল টেলিফোন সবার হাতে হাতে? না, এসবের কিছুই ছিল না। চিঠিই ছিল কোনো সংবাদ পৌঁছানোর একমাত্র অবলম্বন। মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গন থেকে তাঁদের বাড়িতে যোগাযোগ করতো শুধু চিঠি আর বার্তাবাহকের মাধ্যমে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সময় বাড়িতে একটু খবর দেওয়ার জন্য বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা তখন হাতে তুলে নিয়েছিল কাগজ-কলম। সেইসব চিঠিগুলো সংগ্রহ করে ‘একাত্তরের চিঠি’ নামক বইয়ে সংকলন করা হয়েছে। মোট ৮২টি চিঠি স্থান পেয়েছে ব‌ইটিতে। ২০০৯ সালে দৈনিক প্রথম আলো ও গ্রামীণ ফোনের উদ্যোগে চিঠিগুলো সংগ্রহ করা হয়। ব‌ইটির সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন সালাহ‌উদ্দীন আহমদ, আমিন আহম্মেদ চৌধুরী, রশীদ হায়দার, সেলিনা হোসেন ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ। ব‌ইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন, প্রচ্ছদ করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী।

এবার চলো ব‌ইটির ভেতরে প্রবেশ করা যাক। প্রথমেই রশীদ হায়দারের লেখা একটি চমৎকার ভূমিকা আছে। তারপর এক এক করে রণাঙ্গনে লেখা মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠি। চিঠিগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বেশিরভাগ চিঠিই লিখেছেন তরুণ যোদ্ধারা, অল্পশিক্ষিত যুবক আর স্কুল-কলেজের ছাত্র। চিঠিতে সবার মূল বক্তব্য হলো—সবাই যুদ্ধে গেছেন দেশমাতৃকার লাঞ্ছনা ও গ্লানি মোচনের লক্ষ্যে, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে। তাঁদের আগে থেকে কোনো যুদ্ধপ্রস্তুতি নেই, প্রশিক্ষণ নেই, এমনি যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কেও অবগত নন। কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য একটাই—দেশকে স্বাধীন করা।

ছেলে লিখেছে বাবাকে, বাবা লিখেছে ছেলে বা মেয়েকে। স্বামী লিখেছে তার প্রিয়তম স্ত্রীকে। ভাই লিখেছে ভাইকে। লক্ষণীয়, একাত্তরের চিঠির বেশিরভাগ চিঠিই মাকে লেখা। চিঠিগুলো পড়ে মনে হয় মা ও স্বদেশ যেন এক‌ই শব্দ, সমার্থক। জিন্না নামক এক মুক্তিযোদ্ধা ৫ এপ্রিল তাঁর মাকে লিখেছিলেন, “বাংলা মাকে বাঁচাতে যে ভূমিতে আপনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, যে ভাষায় কথা শিখিয়েছেন, সেই ভাষাকে, সেই জন্মভূমিকে রক্ষা করতে হলে আমার মতো অনেক জিন্নার প্রাণ দিতে হবে। দুঃখ করবেন না, মা। আপনার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে যদি আপনার এই নগণ্য ছেলের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়, সে রক্ত ইতিহাসের পাতায় সাক্ষ্য দেবে যে বাঙালি এখনো মাতৃভূমি রক্ষা করতে নিজের জীবন পর্যন্ত বুলেটের সামনে পেতে দিতে দ্বিধা বোধ করে না।” তিনি চিঠির আরেক জায়গায় লিখেছেন, “মা, যদি সত্যি আমরা এই পবিত্র জন্মভূমি থেকে ইংরেজ বেনিয়াদের মতো পাঞ্জাবি গুণ্ডাদের তাড়িয়ে দিয়ে এ দেশকে মুক্ত করতে পারি, তবে হয়তো আবার আপনার সঙ্গে দেখা হবে। বিদায় নিচ্ছি মা। ক্ষুদিরামের মতো বিদায় দাও। যাবার বেলায় সালাম। মা...মা...মা...যাচ্ছি।”

১৩৭৮ সনের ২৭ আষাঢ় মুক্তিযোদ্ধা হক তাঁর বাবাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। বুক ভরে যায় বাবার কাছে লেখা এই চিঠিটি পড়লে। তিনি লিখেছেন, “আব্বা, আমার সালাম ও কদমবুচি গ্রহণ করুন। জীবনের যত অপরাধ, ক্ষমা করে দেবেন। আমি আজ চলে যাচ্ছি, জানি না ফিরে আসব কিনা। যদি ফিরে আসতে পারি, তাহলে দেখা হবে। আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, যেন আপনার ছেলে এ দেশের মুক্তিসংগ্রামে গাজি হতে পারে‌!”

কেউ কেউ চিঠি লিখেছেন তাঁদের আশেপাশের প্রকৃতি আর ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কীভাবে সময় কাটাচ্ছেন, কীভাবে কোথায় ঘুমাচ্ছেন, খাওয়ার সমস্যা হচ্ছে কিনা, তাঁদের কী কী অসুবিধা হচ্ছে —তাও ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁদের বর্ণনায়। ১৫ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা বিপ্লব মাকে লিখেছিলেন, “টিনের চালাঘরে বসে আছি। বাইরে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার সর্বত্র। প্রকৃতির একটা চাপা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে টিনের ওপর বৃষ্টি পড়ার শব্দে শব্দে। মাগো, আজ মনে পড়ছে বিদায়বেলায় তোমার হাসিমুখ। সাদা ধবধবে শাড়িটায় বেশ মানিয়েছিল তোমায়‌।” 

চিঠির শেষের দিকে তিনি লিখেছেন, “পশুত্বের কাহিনি শুনবে, মা? তবে শোনো। ‌শত্রুকবলিত কোনো এক এলাকায় আমার এক ধর্ষিতা বোনকে দেখেছিলাম নিজের চোখে। ডেকেছিলাম বোনকে। সাড়া দেয়নি। সে মৃত। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র দেহে পাশবিক অত্যাচারের চিহ্ন শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে।”

কদবানু আলেয়া তার মুক্তিযোদ্ধা স্বামীকে চিঠি লিখেছিল, “তোমার আড়াই বছরের বড় ছেলে সবসময় পতাকা হাতে নিয়ে জয় বাংলা বলতে থাকে আর রাজাকাররা ধমক দেয়।”

ব‌ইটিতে আছে শহিদ জননী জাহানারা ইমামের বড় ছেলে মুক্তিযোদ্ধা রুমীর ইংরেজি ভাষায় লেখা একটি চিঠি। ছবি : ফেসবুক

ব‌ইটিতে আছে শহিদ জননী জাহানারা ইমামের বড় ছেলে মুক্তিযোদ্ধা রুমীর ইংরেজি ভাষায় লেখা একটি চিঠি। চিঠিটি লিখেছিলেন তাঁর মামাকে। আছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া বেশ কয়েকজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার চিঠি। দশম শ্রেণির ছাত্র, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা আমানউল্লাহ চৌধুরী ফারুক তাঁর বাবাকে রণাঙ্গন থেকে লিখেছিলেন, “Mother and Motherland are superior to heaven. স্বর্গের চেয়েও উত্তম মা ও মাতৃভূমি। আমি তো যাচ্ছি আমার স্বর্গাদপী গরীয়সী সেই মাতৃভূমিকে শত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করতে।” শহিদ হবার কয়েকদিন আগে চিঠিটি লিখেছিলেন তিনি।

প্রত্যেকটি চিঠিতে দিন-তারিখ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভরপুর চিঠি নিয়ে ব‌ইটি তাই এক লহমায় পড়ে ফেলতে পারো। ‘একাত্তরের চিঠি’ আমাদের ইতিহাসের গভীর তাৎপর্য বহন করে। ব‌ইটি পড়ে বুঝতে পারবে ওই সময়কার পরিস্থিতি। কীভাবে কোন পরিবেশে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল! স্বজন-পরিবার বিসর্জন দিয়ে স্বদেশকে শত্রুমুক্ত করতে নিজের জীবন দিতেও কার্পণ্য করেননি তাঁরা।

সর্বাধিক পঠিত