০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
গল্প

বইঘর

সাদিয়া সুলতানা
২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩৩
বইঘর। অলংকরণ : কিশোর ডাইজেস্ট

আজ বৃহস্পতিবার। এহসানের হাফ স্কুল। ড্রয়িং স্যার ক্লাস ছেড়ে একটু আগেই বের হয়ে গেছেন। স্যারদের মিটিং আছে। এক্ষুণি ছুটির ঘণ্টা বাজবে। ছুটির ঘণ্টার ঢং ঢং আওয়াজ শুনতে বেশ ভালো লাগে এহসানের। আসলে ঘণ্টার আওয়াজই ওর খুব ভালো লাগে। ক্লাসে ঢোকার ঘণ্টা, ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা। দপ্তরি চাচা বেশ ভালো। তিনি একদিন টিফিন পিরিয়ডে এহসানকে ঘণ্টা বাজাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু এহসানের বাড়িতে জোরে আওয়াজই হয়নি। তবে জোরে আওয়াজ না হওয়াতে ভালোই হয়েছে, নয়তো সবাই তাড়াতাড়ি টিফিন পিরিয়ড শেষ করে ফেলত। আর টিচাররা এই কাণ্ড টের পেলে নির্ঘাৎ ওর কপালে বকুনি জুটত।

মা স্কুল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এত ভিড়ের মাঝেও এহসান মাকে ঠিকই খুঁজে পায়। কারণ মা অথবা বাবা যেই আসুক না কেন তারা প্রতিদিন ঠিক একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকে। আর ও মা-বাবাকে সহজেই খুঁজে পায়। এহসান স্কুলব্যাগটা দুই হাতে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। ব্যাগটা খুব ভারী। প্রতিদিন ক্লাস শেষে বের হয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে গেট পার হতে গেলেই ওর কাঁধে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। তাই এহসান বুদ্ধি করে বুকের মাঝে ধরে হাঁটে। অবশ্য বুদ্ধিটা বাবার।

সকালে বাবা অফিসে যাবার আগে স্কুলে দিয়ে যায় আর মা অফিস থেকে এক ফাঁকে বেরিয়ে ওকে বাসায় নিয়ে যায়। মায়ের অফিস স্কুলের কাছাকাছি। অবশ্য এহসানদের বাসাও স্কুলের কাছাকাছি। হেঁটেই যাওয়া-আসা করা যায়। এহসান যদিও মা-বাবাকে বলেছে যে ও যথেষ্ট বড় হয়েছে, ক্লাস ফাইভে পড়ে, ও একাই স্কুলে যেতে-আসতে পারবে কিন্তু মা-বাবা রাজি হয়নি। বিশেষ করে মা ওকে একা ছাড়তে ভয় পায়। এহসান বোঝে এই ভয়ের কারণ। ও যদি হারিয়ে যায় বা কেউ যদি ওকে ধরে নিয়ে যায়! এহসান ছেলেধরার গল্প শুনেছে যদিও আজ অব্দি কোনও ছেলেধরা দেখেনি। ও দেখতেও চায় না। ওর ভয় করে। এই জন্য এহসান কখনোই স্কুল গেটের বাইরে যায় না।

এহসানকে দেখেই মা ছুটে এসে ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয়। কাঁধে ব্যাগ ঝোলাতেই মা কাত হয়ে যায়। মায়ের অবস্থা দেখে এহসানের খুব মজা লাগছে। মা কেমন দুলে দুলে হাঁটছে। ঠিকমতো হাঁটতেও পারছে না। পিঠের ভারী ব্যাগসহ মা প্রায় পড়ে যাচ্ছে। এহসান দ্রুত মাকে পেছনে ফেলে সামনে চলে আসে। এহসান জানে মা এক্ষুণি পিছু ডাকবে, ‘বাবা এত তাড়াতাড়ি হাঁটিস না, পড়ে যাবি।’ কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার মা কিছু বলছে না! মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে না পেয়ে এহসান পেছন ফিরে মায়ের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।

এহসানের মুখের দিকে তাকিয়ে মা ক্লান্ত গলায় বলে, ‘তোর ব্যাগে কী রে বাবা? ইট? শিল-নোড়া? না বাটাম-হাতুড়ি?’

এহসান শব্দ করে হাসে। মা রোজই ফেরার সময় একই কথা বলে। এহসানেরও রোজ মজা লাগে আর ও হাসে। ওর হাসিই বলে দিচ্ছে, বোঝো ঠ্যালা আমার কত্ত বোঝা! মায়ের মুখ ধীরে ধীরে লাল হয়ে যাচ্ছে। অল্প একটু পথ। শুধু রাস্তা পার হতে হয়। এতটুকু পথ হাঁটতেই মা একেবারে ঘেমে ভিজে গেছে। মায়ের লালচে মুখ দেখে এবার এহসানের খারাপ লাগে। আহা! মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছে!

‘মা আমাকে দাও আমি নিচ্ছি ব্যাগ।’
‘ওরে সোনা আমারই ঘাড় ব্যথা হয়ে গেল! তুই তো হাঁটতেই পারবি না।’
‘বা রে আমি তো কালও আমার ব্যাগ নিলাম! বাবাকে নিতে দিইনি। আজ বরং দুটো ক্লাস কম ছিল। চারটে বই-খাতা কম।’
এইবার মা হেসে ফেলে।
‘কমেই এই অবস্থা রে বাবা! বেশি হলে কী না জানি হতো! দাঁড়া আজই এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তোর বন্ধুদের বাবা-মা যার যার ফোন নম্বর আছে, আজই দিবি তো আমাকে।’
এহসান ঘাড় কাত করে মায়ের পিছু পিছু হাঁটে।

প্রতীকী ছবি

২.
এহসানের খুব অবাক লাগছে। এ তো বইয়েরই ঘর! বড় লাইব্রেরির মতো। চারদিকে শেলফে সারি সারি বই সাজানো। বাংলা বর্ণমালা, ইংরেজি রাইমসের বই, ছড়ার বই, রূপকথার বই! রাজ্যের সব বই জড়ো করা যেন! কিছু বই ওর পরিচিত। কিছু অপরিচিত। কিন্তু বইগুলো এত চিকন চিকন! এই ঘরের ভেতরে সাতটা টেবিল। সেই টেবিলে সাতটা স্কুল ব্যাগ। একটা ব্যাগের ওপরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছবি, একটাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি। বাকি পাঁচটার কাছে গিয়ে দেখলে বুঝতে পারবে কাদের কাদের ছবি আছে।

হঠাৎ এহসান দেখতে পায় এই বইঘরের সবচেয়ে উঁচু শেলফের সামনে একজন বুড়োমতো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সেই মানুষটা দাঁড়িয়ে থেকেই ঘাড় কুঁজো করে কী একটা বই দেখছে। এহসান দৌড়ে মানুষটার কাছে যায়। নাহ, অপরিচিত এই পরিবেশে ওর একটুও ভয় করছে না।   
‘আপনি কে? লাইব্রেরিয়ান? এটা কি লাইব্রেরি?’

এহসান কৌতূহলভরে প্রশ্ন করে। লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। দূর থেকে তাকে যত বুড়ো দেখাচ্ছিল আসলে মানুষটা তত বুড়ো না। শুধু ঘাড়টা একটু কুঁজো। এহসানের কেন যেন মনে হয়, সারা দিন ঘাড় গুঁজে পড়তে পড়তে মানুষটার মাথা অমন হয়ে গেছে। এহসান ফিক করে হেসে ফেলে।

‘হু। তুমি তো খুব বুদ্ধিমান ছেলে। ঠিকই ধরেছ।’ 
এহসান চমকে ওঠে। তার মানে তিনি ওর মনের কথা বুঝতে পারছেন!
এবার লোকটা জোরে হেসে ওঠে।
‘একদম সব বুঝতে পারছি, বইয়ের সঙ্গে থাকলে মানুষের মনের কথা, বাইরের কথা সব বোঝা যায়।’
‘আর কী কী বুঝতে পেরেছেন আপনি?’
‘বুঝতে পেরেছি, স্কুলব্যাগটা খুব ভারী।’
এহসান চমকে যায়। বাপ রে... মানুষটা কি জাদু জানে?
‘হু, জাদুও জানি। ওজের জাদুকরের কাছ থেকে শিখেছি।’

মানুষটা এবার ওর দিকে একটা বই এগিয়ে দেয়। এহসান বইটি হাতে নিয়ে দেখে এটা লিম্যান ফ্র্যাঙ্ক বউমের ওজের জাদুকর বই। বইয়ের কভার পেজটা চেনা আর প্রিয় এহসানের। ডরোথি আর টোটোও ওর প্রিয়। এহসান যখন অনেক অনেক ছোট ছিল বাবা তখন ওজের জাদুকর বই থেকে ওকে পড়ে শোনাত আর ও আনন্দে হাততালি দিত। কদিন আগেও এহসান স্বপ্ন দেখেছে, ডরোথির মতো ও ওজের জাদুকরের খোঁজে বেড়িয়েছে; পথে খড়ের তৈরি কাকতাড়ুয়া, টিনের কাঠুরিয়া আর ভীতু সিংহের সঙ্গে ওর দেখা হয়েছে।

‘সে হতেই পারে দেখা, তুমি চাইলেই হবে। বইটি পড়লেই দেখতে পাবে সব। পান্নানগরও।’
এতক্ষণে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে এহসান, তাই আর চমকে ওঠে না মানুষটার কথায়। ভাবে মনে মনে জানতে চাইবে, ‘তোমার নাম কী?’
ভাবনার জগতে প্রশ্ন আসতেই আর দেরি হলো না, উত্তর মিলে গেল।
‘আমার নাম নেই।’
‘কী বোকার মতো কথা! মানুষের আবার নাম থাকে না, এমন হয় নাকি! বইয়ের মতো মানুষেরও নাম থাকতে হয়।’
‘তা ভুল বলোনি। তুমি না হয় আমাকে একটা নাম দিয়ে দাও।’

খানিকক্ষণ ভাবে এহসান। বইয়ের আলমারিগুলোর সামনে দিয়ে একবার দ্রুত পায়ে হেঁটে যায়। টেবিলের চারধারে চক্কর কাটে। নাহ, অনেক ভেবেও মানুষটার জন্য জুতসই একটা নাম খুঁজে পায় না ও। কিন্তু বইঘরে হাঁটতে হাঁটতে ছোটদের এত এত বইয়ের নাম মুখস্থ হয়ে যায়। ওই যে ঘরের সবচেয়ে বড় আলমারির একদম ওপরের তাকে ওর খুব প্রিয় একটা বই দেখা যাচ্ছে, ‘কাগজের হাজার সারস।’ গতকাল রাতেও তো ওই বইটাই পড়ছিল এহসান!

‘শোনো, সাদাকোর মতো মনে সাহস রাখো, শুভ ইচ্ছে রাখো। ইচ্ছেপূরণ হবেই। মনে আছে সাদাকোর মায়ের মুখের সেই ছড়াটা?’
অদ্ভুতুড়ে মানুষটার দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুনে ঘাড় কাত করে ছড়াটা জোরে জোরে আওড়ায় এহসান,
‘স্বর্গ থেকে নেমে আসা
ওই সারসের ঝাঁক
তোমার ডানার ছায়ায়
আমার শিশু ভালো থাক।’

প্রতীকী ছবি

৩.
বইঘরের বুড়ো মানুষটার সঙ্গে দেখা হওয়ার বিষয়টা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে এহসানের। স্বপ্নই তো। নয়তো সকাল হওয়ার পর ঘরের কোথাও কাউকে দেখতে পাচ্ছে না কেন? সেই বইঘরটাও তো আর চোখে পড়ছে না। বই পড়ুয়া খাপছাড়া স্বভাবের লোকটাই বা কোথায় গেল?

ভাবতে ভাবতে এহসান স্কুল ড্রেস পরে দাঁত ব্রাশ করে এসে পড়ার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। ব্যাগ গোছানো হয়নি। রাতে ‘কাগজের হাজার সারস’ বইটা পড়তে পড়তে কখন যে চোখ বুজে এসেছিল। বইটা বাবা এবছর বইমেলার সময় কিনে দিয়েছিলেন। ‘কাগজের হাজার সারস’ জাপানের বারো বছর বয়সী মেয়ে সাদাকো সাশাকির জীবনের একেবারে সত্যি গল্প। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুই বছরের সাদাকো বোমার আঘাতে উড়ে দূরে আছড়ে পড়েছিল। শরীরে আঘাত না লাগলেও পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তায় সাদাকোর জীবন কীভাবে বিপন্ন হয়েছিল, কীভাবে কঠিন একটা রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে গেছে ছোট্ট সাদাকো তাই নিয়েই গল্পটা লিখেছেন এলেনর কোয়ের।

অনুবাদ বইটা যতবার পড়ে ততবারই সাদাকোর জন্য মন খারাপ হয় এহসানের। আহারে ওইটুকু একটা মেয়ে, মানুষের হিংস্রতার কারণে ওভাবে অসুস্থ হয়ে গেল! এহসান টিভির সংবাদে দেখেছে, মানুষে মানুষে যুদ্ধ বাঁধে, যুদ্ধে প্রাণ হারায় সেই মানুষই। সাদাকো মরে না গেলেও তো হতো। লেখক এলেনর কোয়ের কি সাদাকোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন না? লেখকদের তো অনেক ক্ষমতা, কত কী লিখে কত জনের জীবনকে বর্ণনা করতে পারেন তাঁরা। তাহলে সাদাকোর জীবনের অশুভকে কেন এলেনর কোয়ের শুভ করে দিতে পারলেন না? বইঘরের লোকটার সঙ্গে আবার দেখা হলে প্রশ্নটা করতে হবে, ভাবতে ভাবতে এহসান ব্যাগে বইখাতা ঢোকাতে থাকে। উফ! আবার ভারী হয়ে গেল ব্যাগটা।

ব্যাগ কাঁধে তুলে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় এহসান। মা ওর জন্য টেবিলে নাশতা দিচ্ছে। বাবা টিফিন বক্সে একটা আলু পরোটা ভাঁজ করে রাখতে রাখতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘টিফিন খেয়ে মনে করে পানি খেয়ে নিবি।’
এহসানকে নিরুত্তর দেখে মা কৌতূহলমাখা কণ্ঠে জানতে চায়, ‘কী হয়েছে তোর? তোর পছন্দের মাংস ভুনা দিয়ে রুটিটা টুক করে খেয়ে নে। আজ আমরা একসঙ্গে বের হব। অফিসে যাওয়ার সময় তোকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাব।’
হঠাৎ এহসানের ব্যাগের দিকে চোখ যায় মায়ের। আচমকা কিছু মনে পড়েছে, হৈ হৈ করে ওঠেন মা।
‘এই রে আবার ঠেসে বই তুলেছিস ব্যাগে! আমার তো বলতে মনেই নেই। বৃহস্পতিবার অফিস থেকে ফেরার পথে অণু, শাওন, হৃদয়, অন্তরের মা বাবাসহ স্কুলে গিয়েছিলাম। স্কুলে গাদি গাদি বই নিয়ে বাচ্চাদের কী লাভ হচ্ছে জানতে চেয়েছিলাম। একে একে অনেক অভিভাবকই জানালেন কোনও লাভ না হলেও বই টেনে টেনে বাচ্চাদের ঘাড় পিঠ ব্যথা হচ্ছে।’
বাবা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন।
‘তারপর স্যার ম্যাডামরা কী বললেন?’
‘তাঁরা একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। তারপর বললেন স্কুলের শিক্ষকদের নিয়ে মিটিং করে জানাবেন।’
হঠাৎ মায়ের ফোনে টুংটাং করে মেসেজ আসে। মা ফোনটা হাতে নিয়ে আবার হৈ হৈ করে ওঠেন।

‘এ্যাই এহসান! পিঠ থেকে ব্যাগ নামা তোর। সুখবর... আজ থেকে তোদের এই ভারী ঝোলা টানা বন্ধ! স্কুলে একগাদি বই নিতে হবে না এখন থেকে। স্কুলের বইঘরে প্রতি ক্লাসের বই থাকবে। ছাত্রছাত্রীরা নিজের চাহিদামতো বই নিয়ে ক্লাসে যাবে। কেউ বই না নিলেও সমস্যা নেই, প্রতি শিক্ষকের কাছে বই থাকবে।’

আনন্দে তালি দিয়ে ওঠে এহসান। তারপরেই থেমে যায়, আচমকা বইঘরের মানুষটার কথা মনে পড়ে যায় ওর, মনে শুভ ইচ্ছে রাখলে ইচ্ছেপূরণ হবেই।

সর্বাধিক পঠিত