১৮ অক্টোবর ২০২৪
গল্প

একাত্তরের রাতুল

মাজহারুল ইসলাম
২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:২৫
একাত্তরের রাতুল। অলংকরণ : কিশোর ডাইজেস্ট

বাবার মৃতদেহ পড়ে আছে বাড়ির উঠোনে। জ্ঞান হারানো মা লুটিয়ে আছেন মাটিতে। রাতুল বুঝতে পারছে না কী করবে সে। সামনে দাউদাউ করে জ্বলছে ওদের টিনের ঘর।

গত দুদিন ধরে পানিহাটা গ্রামে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা আসবে, এই খবর চারদিকে রটে যায়। ফলে এক বাড়ি দুই বাড়ি করতে করতে সম্পূর্ণ গ্রাম ফাঁকা হয়ে পড়ে। সকলে বাড়িঘর ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায় প্রাণভয়ে। রাতুলের বাবা স্কুলশিক্ষক আবদুর রহমান সিদ্ধান্ত নেন, কাপুরুষের মতো গ্রাম ছেড়ে তিনি পালিয়ে যাবেন না। রাতুলের মা আমেনা খাতুন কান্নাকাটি করলে রাতুলকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে বলেন তিনি। কিন্তু আমেনা খাতুন স্বামীকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না।

আবদুর রহমান দুই বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পা হারান। স্ক্রাচে ভর দিয়ে তাঁকে চলাচল করতে হয়। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় নিজে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারছেন না বলে তাঁর আক্ষেপের শেষ নেই। গ্রামের তরুণ-যুবকদের তিনি মুক্তিযুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করছেন। নিজের সীমিত সাধ্যের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে তাদের নানাভাবে সহযোগিতাও করছেন। এই খবর পৌঁছে গেছে শান্তি কমিটির লোকদের কাছে। তারা কয়েকবার এসে তাঁকে শাসিয়েও গেছে। রহমান মাস্টার কারও হুমকি-ধমকির ধার ধারেন না।

মুক্তিযুদ্ধ চলছে প্রায় দুই মাস ধরে। প্রায় রাতেই গোপনে মুক্তিযোদ্ধারা রহমান মাস্টারের বাড়িতে আসে। আমেনা খাতুন তাদের রান্না করে খাওয়ান। মাস্টারের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে শলাপরামর্শ করে মুক্তিযোদ্ধারা।

রাতুলের এই যুদ্ধের গল্প শুনতে ভালো লাগে। দেশের জন্য যুদ্ধ। একটা পতাকার জন্য যুদ্ধ। একটা ফুলকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ। রাতুলের বয়স চৌদ্দ বছর। সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। কিছু কিছু বোঝে সে এই যুদ্ধের কথা। প্রায়ই রাত জেগে অপেক্ষা করে কখন মুক্তিযোদ্ধারা আসবে। তারপর বাবার পাশে বসে যুদ্ধের গল্প শোনে আর ভাবে—ইশ, আমিও যদি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারতাম! আবার কখনও ভয়ে জড়সড়ো হয়ে যায়। শরীরের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে ওঠে। তখন একেবারে বাবার গা ঘেঁষে বসে।

একদিন রাতুল তার বাবাকে বলে, সে মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায়। বন্দুক চালাবে, পাকিস্তানি আর্মিদের গুলি করে মারবে। রহমান মাস্টার ওকে বলে, এখনই না বাবা। তোমার আরেকটু বয়স হোক, তখন তো যাইবাই।

বাপ-ছেলের কথায় আমেনা খাতুন আঁতকে ওঠেন। ছেলেকে কাছে টেনে একেবারে বুকের মধ্যে নিয়ে নেন। কপালে চুমু খান। তারপর রহমান মাস্টারকে বলেন, আফনে কিন্তু আবার ছেলের কথায় মাইতেন না। আফনার তো মাথার কোনও ঠিকঠিকানা নাই। রাতুলরে কিন্তু কোথাও যাইতে দিমু না।

রহমান মাস্টার আমেনা খাতুনের কথার জবাব দেন না। মনে মনে ভাবেন, মায়ের মন, সে তো বলবেই। রাতুলের বয়স যদি আঠারো বছর হতো অবশ্যই তিনি তাকে যুদ্ধে পাঠাতেন।

আজ দুপুরে রান্না শেষ করে ঘরের দাওয়ায় পাটি বিছিয়ে খাবারের আয়োজন করছিলেন আমেনা খাতুন। আর ঠিক তখনই এক মেজরের নেতৃত্বে আট-দশজন পাকিস্তানি সেনা এসে উপস্থিত হয় তাদের বাড়িতে। ভয়ে আমেনা খাতুনের হাত থেকে ভাতের হাঁড়ি পড়ে যায়। আর্মিদের বাড়ি চিনিয়ে এনেছে শান্তি কমিটির সদস্য ইয়াকুব আলী। রহমান মাস্টার ঘরে শুয়ে ছিলেন। ইয়াকুব আলীর ইশারায় তাঁকে ঘর থেকে বের করে আনে দুই সেনা সদস্য। 
স্ক্রাচে ভর দিয়ে মেজরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রহমান মাস্টার। ইয়াকুব আলী মেজর সাহেবকে দেখিয়ে বলল, ইয়ে আদমি মুক্তি হায় স্যার। 
মেজর তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করল। কয়েকটা চড় থাপ্পড় মারল। মুক্তিবাহিনীর অন্য সদস্যরা কোথায় বারবার জানতে চাইল। রহমান মাস্টার কোনও কথারই জবাব দিচ্ছেন না। ইয়াকুব আলী বলল, মাস্টার সাব বইলা ফালান। না হইলে...।

মাস্টার বললেন, না হইলে কী? আমারে খুন করবি? আমারে মাইরা ফায়দা কী? আমি তো একজন। আমার মতো লাখ লাখ রহমান তোদের মোকাবেলার জন্য তৈরি হচ্ছে। জয় বাংলা!

রহমান মাস্টারের কথা শেষ হওয়ার আগেই মেজরের ইশারায় আবার শুরু হলো নির্যাতন। বন্দুকের বাট দিয়ে তিন-চারটা বাড়ি দিতেই স্ক্রাচ হাত থেকে ছিটকে পড়ল এবং একই সঙ্গে রহমান মাস্টারও মাটিতে পড়ে গেলেন। মেজরের ইশারায় আবার তাঁকে দাঁড় করানো হলো। মেজর আবারও জানতে চায়, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা কোথায়? আশপাশে কোথায় তাদের ঘাঁটি? ইয়াকুব আলী এগিয়ে গিয়ে বলল, মাস্টার সাব, জানে বাঁচতে চাইলে বইলা ফালান। এই মুক্তি-ফুক্তি দিয়া লাভ হইব না। নিজে বাঁচলে বাপের নাম।

রহমান মাস্টার চোখ বড় বড় করে তাকালেন ইয়াকুব আলীর দিকে। এরপর মুখ থেকে একদলা থুথু ছুড়ে মারলেন তার দিকে।

থুথু গিয়ে পড়ল ইয়াকুব আলীর পাঞ্জাবির আস্তিনে। ইয়াকুব আলী খানিকটা সরে গিয়ে বলল, এখনও তেজ কমে নাই? একটু খাড়াও মাস্টার। তেজ তোমার কইমা যাইব!

এর মধ্যে দুজন সিপাই রহমান মাস্টারের হাত বেঁধে ফেলল। আমেনা খাতুন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গিয়ে মেজরের পা জড়িয়ে ধরে স্বামীকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু কোনও লাভ হলো না। মেজর পা ছাড়ানোর জন্য জোরে লাথি মারলে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লেন আমেনা খাতুন। মাস্টার চিৎকার করে বললেন, এই কুত্তাদের কাছে মাথা নত করিস না বউ।

আমেনা খাতুন স্বামীর কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে কোনোরকমে উঠে এবার ইয়াকুব আলীর পা ধরে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইলেন। এতেও কোনও লাভ হলো না। বরং ইয়াকুব আলী দাঁত-মুখ খিচিয়ে বলল, কত কইরা কইছিলাম আমার লগে আইতে! তা না কইরা গ্রামের হগ্গলরে মুক্তিযোদ্ধা বানাইতে লাগছে। আহ! দেশ স্বাধীন করব।

মুহূর্তকাল থামল ইয়াকুব আলী। তারপর চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান মেরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল আমেনা খাতুনকে।

রাতুল একটু দূরে কুয়াতলায় বালতিতে পানি তুলে গোসল করছিল। আর্মিদের দেখে ভয় পেয়ে যায় সে। ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকে। কী করবে বুঝতে পারে না। একবার মনে হলো তার হাতে একটা বন্দুক থাকলে সবাইকে গুলি করে মারতে পারত। সে একবার বাবার দিকে একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। তার সামনে বাবাকে মারধর করছে, মা মাটিতে পড়ে কাঁদছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব রাতুল। একটু পর দৌড়ে মাকে মাটি থেকে তুলে জড়িয়ে ধরে। আর ঠিক তখনই পর পর দুই রাউন্ড গুলির শব্দ তার কানে আসে। রাতুল চকিতে ঘুরে দেখে তার বাবা মাটিতে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। আহা! কী ভয়ানক বীভৎস দৃশ্য। রাতুলের মা আমেনা খাতুন বিড়বিড় করে সূরা ইয়াসিন পাঠ করছিলেন। গুলির শব্দে তাঁর সূরা পড়া বন্ধ হয়ে যায়। রাতুল দৌড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। আমেনা খাতুন সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন।


রাতুল এক কাপড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা চলে যায়। সেখান থেকে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছে যায় মেলাঘরে। রাতুল শুনেছে মেলাঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়। কয়েক মাইল এলাকাজুড়ে মেলাঘর ক্যাম্পটি পাহাড় ও জঙ্গল পরিবেষ্টিত। যে কোনও ভাবেই হোক তাকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে হবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল তার বয়স। এত অল্প বয়সে তাকে মুক্তিযুদ্ধে নিতে কেউ রাজি হয় না। রাতুলও নাছোড়বান্দা। অসীম ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। পাহাড়ে জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে আর ভাবে, এদের মধ্যে কারও বাবাকে কি তার সামনে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনারা? দূর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেখে। মাঝেমধ্যে তাদের ছোটখাটো ফুটফরমাশও খাটে। এভাবে তিন-চার দিন পার হয়ে যায়। প্রতিদিন হাজারও মানুষ মেলাঘরে আসতে শুরু করে। যুবকেরা আসছে এই ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাতে আর অন্যেরা আসছে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। রাতুলের দিন কাটে খেয়ে না-খেয়ে। তবু সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—মুক্তিযুদ্ধে যাবেই।

একদিন রাতুলের সঙ্গে দেখা হলো এক মুক্তিযোদ্ধার। রাতুল তার পিতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিল তাকে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার বিষয়ে তার সহযোগিতা চাইল। রাতুলের হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা শুনে মুক্তিযোদ্ধার চোখ ভিজে ওঠে। রাতুলকে জড়িয়ে ধরে আদর করেন তিনি। বলেন, আমি একটা প্লাটুনের কমান্ডার। নিশ্চয়ই তুমি যুদ্ধে যাবে। সে ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি। আমরা সবাই মিলে তোমার বাবার হত্যাকারীদের ধ্বংস করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করবই। আজ থেকে তুমি মুক্তিযোদ্ধা। জয় বাংলা!

প্রশিক্ষণ শুরু হয় রাতুলের। বড়দের সঙ্গে সেও নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ছিল পনের দিনের। এই প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন হায়দার, শওকত আলী, গাফফার, আইনুদ্দিন ও অন্যেরা। বয়সে ছোট হওয়ার কারণে সকলেই রাতুলকে স্নেহ করেন।

রাতুলের থাকার জায়গা হয়েছে পাহাড়ের ওপর নির্মিত একটা ব্যারাকে। এর চারদিকে বাঁশের বেড়া এবং উপরে ছন বিছানো। বাঁশ দিয়ে বানানো মাচার ওপর ঘুমানোর ব্যবস্থা। কোনও তোষক-বালিশের কারবার নাই। সবাই যার যার জামাকাপড় বিছিয়ে রাতে ঘুমায়। সমস্যা হলো রাতুল এসেছে এক কাপড়ে। হাতে তেমন টাকা-পয়সাও নেই। ওই প্লাটুন কমান্ডার তাকে দুটো শার্ট-প্যান্ট এবং একটা গামছা কিনে দিয়েছেন।

প্রায় দোতলাসমান পাহাড়ের নিচে হলো কুয়া। সেখান থেকে খাবার পানি আনতে হয়। গোসল করতে যেতে হয় লেক বা ঝর্ণার পানিতে। গোসল করে উঠে এলে দেখা যায় শরীরে দুই-একটা জোঁক লেগে আছে। রাতুল জোঁকের ভয়ে গোসল করাই বন্ধ করে দিল। খাওয়াদাওয়া খুবই সাধারণ। সকালে রুটি-ডাল, দুপুরে ও রাতে ভাত, সবজি ও ডাল। প্রতি সাত দিনে একবার ছাগির মাংস। সবাই বলে ‘লেডিস খাসি’। লঙ্গরখানায় পেল্লাই আকারের হাঁড়িতে দিন-রাত রান্না চলছে। সেখান থেকে যার যার ইউনিটের খাবার নিয়ে যাচ্ছে সবাই।

একদিন গভীর রাতে রাতুলের ঘুম ভেঙে গেল নারীকণ্ঠের আওয়াজে। মনে হলো দূরের কোনও টিলা থেকে ভেসে আসছে করুণ আর্তনাদ। 
অস্ত্র দে! একটা অস্ত্র দে! বদলা আমি নেবই। জানি তোরা পারবি না শোধ নিতে। দে, অস্ত্র দে...!

রাতুল বুঝতে পারে না—কে এই নারী? কেন তিনি শোধ নিতে চান? বদলা নিতে চান কিসের? কী অন্যায় হয়েছে তাঁর প্রতি, যে, তিনি প্রতিশোধস্পৃহায় এরকম উন্মাদ হয়ে উঠেছেন?

রাতভর ঘুমাতে পারে না রাতুল। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে শুধু। সকালে একজনের কাছ থেকে জানতে পারে, ওই নারী পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে আসা হয় এখানকার হাসপাতালে। সুস্থ হলে কাছেই কোনও শরণার্থী শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও এই নারী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন পুরোপুরি। ডাক্তাররা বলছেন হানাদার সেনাদের নির্যাতনের কারণেই এমনটা হয়েছে। এখানকার পরিচিতরা তাঁকে ভালোবেসে ‘পাগলি বোন’ বলে ডাকে।

সব শুনে রাতুলের ভীষণ মন খারাপ হয়। মার কথা খুব মনে পড়ে তার। এখানে আসার আগে মামাবাড়িতে রেখে এসেছে মাকে। রাতুল জানে না মা এখন কেমন আছেন। মার জন্য রাজ্যের দুশ্চিন্তা ভর করে রাতুলের মাথায়।


প্রশিক্ষণে প্রথম যেদিন অস্ত্র হাতে নেয় রাতুল সেদিন তার সমস্ত শরীরে আলাদা একটা শিহরণ বয়ে যায়। একধরনের উত্তেজনা অনুভব করে সে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবার খুনি সেই মেজর এবং রাজাকার ইয়াকুব আলীর চেহারা। আর তখনই ছোট্ট রাতুল যেন হঠাৎ করে অনেক বড় হয়ে ওঠে। তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে যায়। রাতুল শুনেছে, শুধু তার বাবা নয়, এরকম অসংখ্য বাবাদের নির্বিচারে হত্যা করছে ওরা। গ্রামের মেয়েদেরও ধরে নিয়ে নির্যাতন করছে। সারা দেশে অসংখ্য মানুষের ওপর জুলুম নির্যাতন চালাচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। তাই তো হিংস্র নরপশুদের পরাজিত করে দেশকে স্বাধীন করতে হবে—এই ইস্পাতকঠিন শপথ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে।

প্রতিটি ব্যাচের ট্রেনিং শেষে মেজর খালেদ মোশাররফ স্বয়ং শপথ পাঠ করান। শপথের প্রতিটা শব্দ রাতুলের মুখস্থ।

“আমি সজ্ঞানে সুস্থ শরীরে শপথ করিতেছি যে, আমি আমার প্রাণের বিনিময়ে হইলেও কৌশলগত কারণে গঠিত প্রতিনিধিমূলক সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করব। আমি আরও শপথ করিতেছি যে, মুক্তিবাহিনীর একজন সৈনিক হিসেবে আমার মাতৃভূমি, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সর্বশক্তি নিয়োগ করিব। জয় বাংলা!”

শপথ পাঠের সময় প্রত্যেকের চোখে মুখে ফুটে ওঠে যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন। এই স্বপ্নকে ঘিরে আছে নতুন এক আশার আলো। পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম নতুন দেশের স্বপ্ন।


পনের দিনের প্রশিক্ষণ শেষে কমান্ডার জলিলের নেতৃত্বে রাতুলসহ বিশজনের দল ভারতীয় সীমান্তবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সোনাহাটি গ্রামের জঙ্গলে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি আর্মিরা কাছাকাছি একটা জায়গায় ঘাঁটি গেড়েছে খবর পেয়ে এখানে তাদের আসা। জলিলের দল দুদিন ধরে এখানে অপেক্ষা করছে, সুযোগ বুঝে আক্রমণ চালানোর জন্য। প্রশিক্ষণ শেষে হাতেকলমে শিক্ষাগ্রহণ এই অপারেশনের আরেকটি লক্ষ্য। সব মুক্তিযোদ্ধাকেই প্রশিক্ষণ শেষে এ ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হয়।

তৃতীয় দিন মধ্যরাতে পাকিস্তানি আর্মিরা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পায়। শুরু হয় গোলাগুলি। উভয় পক্ষই সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে। আগে থেকেই খুঁড়ে রাখা ট্রেঞ্চের মধ্যে অবস্থান নেয় রাতুল। সেও মাঝে মাঝে গুলি করছে। মাথার এক ইঞ্চি উপর দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা খুব সুবিধা করতে পারছে না। পাকিস্তানি আর্মিরা সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। একপর্যায়ে জলিলের দল পিছু হটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কীভাবে যাবে? ফ্রন্টলাইনে কাউকে থেকে তো গুলি চালিয়ে যেতে হবে, নয়তো সকলেই মারা পড়বে। সময় খুব কম। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এমন সময় রাতুল এগিয়ে এসে দলনেতা জলিল ভাইয়ের হাত থেকে স্টেনগান নিয়ে বলে, তোমরা সবাই দ্রুত পিছু হটতে থাকো। আমি গুলি চালাচ্ছি। যাও, তোমরা দেরি করো না! বলেই গুলি চালানো শুরু করল।

সবাই এর-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কী সাংঘাতিক! এই ছেলে বলে কী! কী সিদ্ধান্ত নেবে বুঝতে পারছে না কেউ। অবশেষে কমান্ডার জলিলের নির্দেশে সকলে পিছু হটতে শুরু করে।

রাতুল ট্রেঞ্চের ভেতর নেমে স্টেনগান উপরে রেখে এলোপাতাড়ি গুলি করে যাচ্ছে। তার চোখেমুখে শত্রুকে প্রতিরোধ ও নিধনের প্রতিজ্ঞা। পিতা রহমান মাস্টারের মাটিতে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত নিস্তেজ শরীরটা চোখের সামনে ভাসছে। স্বামীকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টারত মায়ের করুণ আকুতি কানে বাজছে। মেজরের পা ধরে মায়ের কান্নার শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে বারবার ফিরে আসছে তার কানে। ইয়াকুব আলীর কুৎসিত বীভৎস চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে আর স্টেনগানের ট্রিগারে রাখা আঙুল যেন আরও শক্ত হয়ে উঠছে।

রাতুল যেন উন্মাদ হয়ে গেছে। তার উপর্যুপরি আক্রমণে পাকিস্তানি আর্মি একপর্যায়ে মনে করে, মুক্তিযোদ্ধারা মনে হয় অনেক সংগঠিত হয়ে এগিয়ে আসছে। কাজেই এবার তারা পিছু হটতে শুরু করে। রাতুল তারপরও ক্রমাগত গুলি করেই যাচ্ছে। এভাবে রাত প্রায় শেষ হয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা ততক্ষণে সব পালিয়ে গেছে।

পুবের আকাশে সূর্য উঠছে। অরুণোদয়ের কোমল ও স্নিগ্ধ আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেছে। জলিলসহ দলের প্রায় সকলের মধ্যেই একধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে। সবাই অস্ত্র হাতে মাথা নিচু করে বসে আছে। একজন কিশোরের জীবনের বিনিময়ে তারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে এসেছে। তারা নিশ্চিত রাতের গোলাগুলিতে রাতুল মারা গেছে। সারা রাত যে পরিমাণ গোলাগুলি হয়েছে তাতে রাতুলের বেঁচে থাকার কোনও কারণ নেই। এই কিশোরের মায়ের কাছে কী জবাব দেবে তারা! কয়েকজন এগিয়ে যায় রাতুলের মৃতদেহ সংগ্রহ করতে।

রাতুলকে যেখানে রেখে গিয়েছিল সেখানে তারা আসে। কিন্তু রাতুল সেখানে নাই। আশপাশে কোথাও রাতুলকে খুঁজে পাওয়া গেল না। এরমধ্যে শামসুল ট্রেঞ্চের কাছে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে। সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় রাতুল ট্রেঞ্চের মধ্যে বসে আছে। তার পাশে স্টেনগান রাখা। রাতুলের চোখেমুখে সামান্য ক্লান্তির ছাপও নাই, মুখে লেগে আছে বিজয়ের হাসি। জলিলসহ সবাই ট্রেঞ্চের মধ্যে নেমে রাতুলকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। মতি রাতুলকে কাঁধে তুলে নিয়ে রীতিমতো নাচতে থাকে। আনন্দে রাতুলের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ওর সামনে এখন লক্ষ্য একটাই, যে কোনও মূল্যেই হোক দেশকে স্বাধীন করতেই হবে। রাতুলের কিশোরকণ্ঠ থেকে বজ্রস্বরে ধ্বনিত হয়, ‘জয় বাংলা!’

সর্বাধিক পঠিত