০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
গল্প

ক্লাসরুমে অঘটন

মাহাথির আরাফাত
৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:১০
ক্লাসরুমে অঘটন। অলংকরণ : কিশোর ডাইজেস্ট

‘আমার একটা ভূত আছে। সে আমার খুব ভালো বন্ধু। গতকাল রাতেও তো কথা হয়েছে।’

কথাটা যখনই আলমগীর বলল, আমরা যেন আকাশ থেকে পড়লাম। ক্লাসের সবাই আলমগীরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আলমগীর যেন একটা আস্ত টেলিভিশন, সবাই তাকে দেখছে। একটু আগে বাংলা প্রথম পত্র ক্লাস শেষ হয়েছে। খলিল স্যার আজ পড়িয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তৈলচিত্রের ভূত’ গল্পটি। ক্লাস শেষে স্যার বলেছেন, ‘ভূত বলে কিছু নাই। সবই কুসংস্কার। আমাদের আরও বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে।’ স্যার ক্লাস থেকে বের হওয়ার পরই আলমগীর দাঁড়িয়ে বলল তার ভূতের কথা। আমরা বললাম, ‘তুই এসব কী বলছিস?’ আলমগীর ন্যাকামি স্বরে বলল, ‘ভূতটা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে।’ আমরা জানতে চাইলাম কী দিয়েছে। সে বলল যে, বলা যাবে না। বললে ভূতটা নাকি খুব মাইন্ড করবে। কী তাজ্জব কথা রে বাবা!

আমরা আলঙ্গীরের কথাটা একদম‌ গুরুত্ব না দিয়ে হেসে উড়িয়ে দিলাম। আলমগীরকে আমরা আলঙ্গীর ডাকি। কেউই ভালো করে আলমগীর বলে ডাকে না। সবাই বলে আলঙ্গীর। তার মাথায় একটু গণ্ডগোল আছে। গ্রীষ্মকালে স্কুলে আসা তার জন্য নিষেধ। কারণ গরমের দিন তার পাগলামিটা বেড়ে যায়। গতবার হেডস্যারের দামি মোটরসাইকেলটা সে পুকুরে ফেলে দেয়। টয়লেটে গিয়ে করেছিল আরেক কাণ্ড। টয়লেটের মেঝেতে পায়খানা করে একটা বিশ্রি অবস্থা করেছিল। এখন গ্রীষ্মকাল, এজন্য মনে হয় তার মাথাটা একটু খারাপ। তাই আমরা কেউ তার কথাটা কানে নিলাম না।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে হঠাৎ বলে ফেলল, ‘ভূতটা কিন্তু আমার সাথেই থাকে। যখন আমি ডাকব, তখনই চলে আসবে। তোরা যদি বলিস তাহলে ডাকতে পারি। কি তোরা দেখবি নাকি?’

আমরা ভীষণ চমকে উঠলাম। আমাদের মনে অজানা ভয় ও চাপা আতঙ্ক। সবার হৃৎপিণ্ডটা একটু বেশি করেই লাফাচ্ছে। ক্লাসের সবচেয়ে গুন্ডা ছেলে জগলু বলল, ‘এত তেড়িবেড়ি করতাছোস ক্যান? আমার সামনে বাহাদুরি করিস না। তোর পাগলামি আমি ছুটাইয়া দিমু।’ জগলু আরেকটু চোখ বড় করে বলল, ‘হে ভূত দেখছে। কত বড় কর্ম সাধন করছে। এরেই কয় সাপের পা দেখা।’

আলঙ্গীর শান্তভাবে বলল, ‘আমার কাছে কিন্তু একটা পোষা সাপও আছে। গোখরা। এক কামড়েই খতম করে দেবে। তবে আমাকে কামড় দেয় না। আমার ব্যাগে সাপটা আছে। বের করব নাকি?’ এই কথায় ক্লাসের মেয়েরা চেঁচামেচি করতে করতে বের হয়ে গেল। ওরা বুঝে গেছে আলঙ্গীর একটা কিছু করে ফেলবে। জগলু রাগে আলঙ্গীরের ব্যাগটা চেইন খুলে উপুড় করল। প্রথমে বইগুলো পড়ল। তারপর সত্যিই দুই হাত লম্বা একটা সাপ পড়ল মেঝেতে। ফণা তুলে ফস্ ফস্ করতে লাগল। আমাদের প্রত্যেকের চোখ কপাল পেরিয়ে একেবারে উঠে গেল মাথায়। কয়েকজন চেঁচামেচি শুরু করে দিল। কয়েকটা মেয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েছিল। আর সাথে সাথেই ভয়ানক কাণ্ড। মেয়েদের চিৎকারে খলিল স্যার অফিস থেকে দ্রুত এলেন।  তিনিও ভীষণ সর্পভীতু। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। স্যার বললেন, ‘সাপ কোত্থেকে এলো?’ আলঙ্গীর বীরের মতো বুকটা দশ হাত ফুলিয়ে গর্বের সাথে বলল, ‘স্যার, সাপটা আমার পোষা। আজকে ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু জগলু বের করে ফেলেছে। আমার কোনও দোষ নাই।’ খলিল স্যার থ বনে গেলেন। অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রের ব্যাগে যে সাপ থাকতে পারে তা উনার কল্পনাতেও ছিল না। খলিল স্যার ধমকের সুরে চেঁচিয়ে বললেন, ‘তুই কি সাপুড়ে? স্কুলব্যাগে থাকবে বই, খাতা, কলম। কিন্তু সাপ কেন?’ আলঙ্গীর কোনও কথা খুঁজে পায় না। সে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সাপটা আস্তে আস্তে আলঙ্গীরের পা বেয়ে সারা শরীর পেরিয়ে একদম গলায় এসে প্যাঁচ দিয়ে বসল। এই দৃশ্য দেখে সবার আক্কেল গুড়ুম হওয়ার মতো দশা।

পরদিন আলঙ্গীরের সাথে কেউ বসল না। সে একাই একটা বেঞ্চে বসেছে। সে এখন ক্লাসের ত্রাস। তাকে দেখে সবাই ভয় পাচ্ছে। এমনকি জগলুও। খলিল স্যার ‘তৈলচিত্রের ভূত’ গল্পের ওপর দশটা জ্ঞানমূলক প্রশ্ন দিলেন লিখতে। তারপর গতকালের মতো আজকেও বললেন, ‘আমাদের বিজ্ঞানসম্মত ধারণা থাকতে হবে। তবেই আমরা এসব ভূত-টুত থেকে দূরে থাকতে পারব।’ আলঙ্গীর তখন দাঁড়িয়ে বলল, ‘তার মানে আপনি বুঝাতে চাইছেন ভূত বলে কিছু নাই? ভূত যে আছে এটা আমি আজ প্রমাণ করে ছাড়ব। বড় বড় বিজ্ঞানীদের নামের পাশে আরেকটা নাম প্রতিষ্ঠিত করব। আর সেটা হলো ‘বিশিষ্ট ভূতবিজ্ঞানী আলমগীর কবীর’।

সবাই হো হো করে হেসে দিল। ক্লাসের এক রোল নুসাইবা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘তাহলে দেখাও তোমার ভূত। আমরা দেখি সেই মহান জিনিস।’ আলঙ্গীর বিজ্ঞের মতো উত্তর দিল, ‘ভূতদের মহান বলতে হয় না। ওরা এমনিতেই মহান। শুধু মহান না, একেবারে গ্রেট। ভূত দ্য গ্রেট। এখন তোমাদের সামনে কি ভূতটা বের করতে পারি?’

সবাই ভীষণ অপেক্ষা করছে। না জানি আলঙ্গীর কী বের করে বসে। এদিকে খলিল স্যার মনে মনে ভাবছেন, ছেলেটার চিকিৎসা হওয়া দরকার। নইলে দিন দিন আরও খারাপ অবস্থা হবে। ছি...ছি...ছি... আমি একজন ব্যর্থ শিক্ষক। ছাত্রদের ভূত বিষয়টা পর্যন্ত বোঝাতে পারলাম না। ছি...ছি...ছি...।
আলঙ্গীর তার টিফিন বক্সটা খুলল। তারপর বলল সবাইকে, ‘ভূত তো বের হতে চায় না। ও ভারি লাজুক ভূত। এখন কী করি! আচ্ছা, তোমরা কিছু চাও যেটা ভূতটা এনে দেবে।’

ফার্স্ট বেঞ্চে বসা ছাত্ররা বলল, ‘সন্দেশ আনতে বলো। আমরা সন্দেশ খাব।’ কয়েকটা মেয়ে বলল, ‘আমরা চকোবার আইসক্রিম খাব।’ জগলু উচ্চস্বরে বলল, ‘আমি দেশি মুরগির রোস্ট খাব।’ শেষ বেঞ্চে বসা মেয়েরা বলল যে, তারা কাচ্চি বিরিয়ানি খাবে। আলঙ্গীর পড়ে গেল মহাঝামেলায়। সে এখন কোনটা রেখে কোনটা আনবে? তাই বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, ‘ভূতেরা এসব খায় না। তাই তারা এসব খাবারও আনতে পারবে না। ভূতেরা খায় পানির মাছ, বন জঙ্গলের ফলমূল, সাপ বিচ্ছু ব্যাঙ—এইসব। মাঝেমধ্যে আলো খায়। চাঁদের আলো তাদের খুব পছন্দ। খেতে নাকি হেব্বি টেস্ট। এখন তোমরা তো এসব খাও না। তাই খাওয়ার বিষয়টা ক্যানসেল।’

খলিল স্যার এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। আচমকা তিনি বললেন, ‘নাম আমার খলিল। আমি দলিল ছাড়া কথা কই না (এটা স্যারের কমন ডায়ালগ)। আলঙ্গীর একটা বদের হাড্ডি। সে তোদের বোকা বানিয়েছে। তোরা হ‌ইলি সবগুলো গাধা।’ আলঙ্গীর বিদ্রোহ করে বলল, ‘আমি এখনই ভূত দেখাচ্ছি সবাইকে। এই কুট্টুস, বের হয়ে আয় তো। ভয় কীসের, হুমম? ও আরেকটা কথা বলা হয়নি—আমার ভূতের নাম কুট্টুস। নামটা ওর মা রেখেছিল, সুন্দর না? নাহ, ও আসলে লজ্জা পাচ্ছে। বের‌ই হচ্ছে না। এক কাজ করি, আমি অদ্ভুত কিছু করি যেটা দেখলে সবার বিশ্বাস হবে আমার কাছে সত্যিই ভূত আছে। এই কুট্টুস, আমাকে এই ক্লাসের বাইরে নিয়ে যা। তারপর একশো হাত ওপরে তোল। দেখিস ফেলে দিস না আবার।’

সত্যি সত্যিই ক্লাস থেকে উড়ে উড়ে চলে গেল আলঙ্গীর। তারপর মাটি থেকে ঠিক একশো হাত ওপরে ভেসে থাকল শূন্যে। এই দৃশ্য দেখে খলিল স্যার অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কয়েকটা মেয়ে উনাকে ধরল। আমাদের চোখে ঘুটঘুটে অন্ধকার‌। কিছুই খেলছে না মাথায়। সবাই যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি, অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। স্কুলমাঠে এই ভয়ানক দৃশ্য দেখার জন্য সব ছেলেমেয়ে হাজির হলো। কারও মুখে কথা নেই। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা বলল, ‘নিউটনের সূত্রটা মনে হয় নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা ভাসছি না কেন?’ স্যারেরা সবাই হায় হায় করছেন, ‘এ কী করে সম্ভব?’
একশো হাত ওপর থেকে আলঙ্গীর বলল, ‘আমার ক্লাসের যারা আছ, তারা ক্লাসে গিয়ে দেখো তোমরা যে যা খেতে চেয়েছিলে সবই সাজানো আছে। আমি মনে করেছিলাম এসব খাবার কুট্টুস আনতে পারবে না। এখন দেখছি তা না, ও সবকিছুই আনতে পারে। ও ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। তোমরা সবাই ক্লাসে চলে যাও।’

আমরা যারা অষ্টম শ্রেণির, তারা সবাই ক্লাসে গিয়ে দেখলাম—সন্দেশ, আইসক্রিম, মুরগির রোস্ট, কাচ্চি বিরিয়ানি খুব সুন্দর করে সাজানো। আমরা জীবনে আগে এত অবাক কখনোই হ‌ইনি। এমন তেলেসমাতি কাণ্ড দেখে সবাই খুব উত্তেজিত। আলঙ্গীর ভূত পেল কোথায়? এত বড় একটা ঘটনা ঘটাল কেমনে সে? ভাবতেই গায়ে কাঁটা লাগে।

ধুর যা! আগে খেয়ে নিই। পরে ভাবা যাবে।

সর্বাধিক পঠিত