০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

‘সুপার ৩০’ চলচ্চিত্র ও অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ

ড. কামরুল হাসান মামুন
১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১৯:১০
ড. কামরুল হাসান মামুন। অলঙ্করণ: কিশোর ডাইজেস্ট

‘সুপার ৩০’ নামে একটা হিন্দি সিনেমা আছে। আমাদেরও সুপার আবদুল মজিদের নামে একটি সিনেমা হতে পারে। ‘সুপার ৩০’ সিনেমায় একজন কোচিং শিক্ষককে সিনেমার নায়ক হিসেবে গল্পে তুলে ধরা হয়েছে। ছবিতে একজন কোচিং সেন্টারের শিক্ষক কীভাবে সমাজের গরিব অথচ মেধাবীদের টেনে তুলে নেন, তা তুলে ধরা হয়েছে। কোচিং সেন্টারের সেই শিক্ষক আনন্দ কুমার গণিতে খুব ভালো ছিলেন। বানারাস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে গিয়ে লেখাপড়া করতেন। তাঁর একটি গবেষণা আর্টিকেল একটি জার্নালে ফিচার্ড হয়েছিল এবং সেই সুবাদে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণও এসেছিল। কিন্তু এর মধ্যে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার কারণে ক্যামব্রিজে যাওয়া হয়নি। কিন্তু আনন্দ কুমারের বিনা বেতনে গরিবদের কোচিং করানোর ফলে ৩০ জন ছাত্র আইআইটির ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।

আমাদের সুপার অধ্যক্ষ আবদুল মজিদের পপি গাইড নিয়ে গত দুই দিন যাবৎ পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা জানছি তা আনন্দ কুমারের চেয়ে একটুও কম না। আবদুল মজিদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৯৫ সালে কলেজে শিক্ষকতার অবসরে তিনি গাইড বই (সহায়ক বই) লেখা শুরু করেন। নিজের আদরের কন্যা পপি নামে এই গাইড বই বাজারে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। হাতে আসে টাকা। এই টাকা দিয়ে তিনি কুমিল্লার মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুরে গড়ে তোলেন কলেজ। একদম নিজস্ব অর্থায়নে। ১৯৯৭ সালে এই কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সাতজন শিক্ষার্থী মেধাতালিকায় স্থান পায়।

অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ ও তাঁর পপি গাইডের লোগো।

আমার ফেসবুক বন্ধু এবং পপি গাইড দ্বারা উপকার পাওয়া একজন মানুষ চন্দ্র নাথের একটা স্ট্যাটাস পড়লাম। সেই স্ট্যাটাস থেকে জানলাম তাঁর অনেক ছাত্র বুয়েটে পড়েছেন, বুয়েটের শিক্ষক হয়েছেন এবং আমেরিকায় গিয়ে সফল হয়েছেন। 

অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ—সত্যিই এক বিস্ময়! তিনি এবারের নির্বাচনে কুমিল্লার স্বতন্ত্র এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচন কেমন হয়েছে, সুষ্ঠূ হয়েছে কিনা, মানুষ ভোট দিয়েছে কিনা—এসব বিতর্ক একটু পাশে রেখে আসুন একবার একজন ভালো মানুষের জীবনের গীত গাই। নব্বইয়ের দশকে ছাত্রছাত্রীরা ‘এসো নিজে করি’ নামক এক যাঁতাকলে পড়ে যায়। ঠিক যেমন এরপর আরেকটা প্রজন্ম সৃজনশীল পদ্ধতির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে। সেই সময় বাজারের সমাধান বইগুলোতে প্রশ্নগুলোর বেশির ভাগের উত্তর থাকত ‘নিজে করো’!

তাই তো হওয়ার কথা। বিজ্ঞান বইয়ে পড়ে যেমন কিছু বোঝা যেত না, তেমনই আবার প্রশ্নগুলোও তেমনই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ছিল। সেগুলোর আগা-মাথা কিছু বোঝাও দুঃসাধ্য ছিল। ও হ্যাঁ, প্রশ্নগুলো তো ছিল আবার প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছাড়াই! এ কারণে উত্তর ছিল ‘নিজে করো’ বা ‘নিজে চেষ্টা করো’ নামে!

সুতরাং গ্রামে যে দুয়েকজন শিক্ষক সায়েন্সের সাবজেক্ট পড়াতেন প্রাইভেটে, নোট পাওয়ার প্রত্যাশায় অনেক শিক্ষার্থীর পরিবার লোন করে হলেও সেখানে পড়ানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু সবার প্রাইভেট বা কোচিংয়ে পড়ার সাধ থাকলেও অনেকের সাধ্য ছিল না। তাদের জন্য পপি গাইড আশীর্বাদ হয়ে আসে। পপি গাইডের কারণে অনেকেই রেজাল্ট ভালো করতে লাগল। পপি গাইডের সুনাম ছড়াতে থাকল। আর পপি গাইডের মালিক সেই অর্থ দিয়ে বাড়ি গাড়ি করার বদলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তিনি শুধু নামমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়েননি। মানের দিকেও খেয়াল রেখেছেন। ইতিমধ্যে হোমনায় একটি হাসপাতাল করেছেন। এখন একটি মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলার স্বপ্ন তাঁর।

সারা দেশের মানুষের উচিত আবদুল মজিদের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া। বর্তমানে কোনও বড় দলের নেতার ব্লেসিং ছাড়া, কোনও গডফাদারের ব্লেসিং ছাড়া, কিছু মাস্তান নিয়োগ ছাড়া কেউ নির্বাচনে জয় সাধারণত পায় না। বাংলাদেশে এখন কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ না দিয়ে নির্বাচিত হওয়া যে কত দুরূহ ব্যাপার সেটা আমরা সবাই জানি। অধ্যক্ষ মজিদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি সমাজের মানুষদের স্বপ্ন দেখাতে পেরেছেন এবং মানুষও নিশ্চয়ই তাঁর ওপর আস্থা রাখতে পেরেছেন। এই ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে খুবই ইতিবাচক।

আমি খুব চাই আবদুল মজিদ ধরনের মানুষদের নিয়ে সিনেমা হোক। আমাদের নতুন প্রজন্ম জানুক যে কেবল অর্থ আর ক্ষমতাই সব না। মানুষের জন্য কিছু করতে পারাই জীবনের আসল সাফল্য।

লেখক : অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বাধিক পঠিত