১৯৭৮ সালে আমরা এক আবাসিক বিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, সেখানে আমাদের ইংরেজিতে কথা বলা বাধ্যতামূলক। আমরা ইংরেজি পারি বা না পারি, কথা বলা শুরু করলাম। ভুলভাল বলি, ভুল বললেই শাস্তি হয়। এমন ভুল-শুদ্ধ মিলিয়েই ইংরেজি শেখা শুরু করি।
একদিন একজন শিক্ষক আমাদের এক বন্ধুকে শাস্তি দেওয়ার সময় বললেন, ‘ইউ ব্লাডি ফুল, গেট আউটসাইড দ্য ক্লাসরুম, স্ট্যান্ড দেয়ার অ্যান্ড ক্যাচ ইয়োর ইয়ারস।’
আমাদের বন্ধু তাঁর আদেশের প্রথম অংশ বুঝলেও শেষ অংশটা বোঝেনি। সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। স্যার তখন বাইরে গিয়ে তাকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। তখন আমরা জানলাম যে ‘ক্যাচ ইয়োর ইয়ারস’-এর অর্থ ‘দুই কান ধরা’।
আমাদের অনেকের মনেই তখন প্রশ্ন জেগেছিল, ‘একটা ক্রিকেট বল ক্যাচ করা আর কান ক্যাচ করা কী একই রকম?’ এ প্রশ্ন আমাদের শিক্ষককে করার সাহস পাইনি, তবে ছয় বছরের স্কুলজীবনে আমরা সবাইই কান ধরার ক্ষেত্রে ‘ক্যাচ’ শব্দটি ব্যবহার করেছি।
এ স্কুলেই সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে ভূগোল ও ইতিহাসের বই ছিল ইংরেজিতে। তবে বই ইংরেজিতে পড়লেও বিষয় দুটিতে পরীক্ষা দিতে হতো বাংলায়। আমরা জেনেছিলাম, আগে আমাদের বড় ভাইয়েরা পরীক্ষা ইংরেজিতেই দিতেন, তবে স্বাধীনতার পর সর্বস্তরে বাংলা চালু করার প্রত্যয় নিয়ে পদ্ধতি বদলে দেওয়া হয়।
আমরা যখন নবম ও দশম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমাদের টেস্টপেপার থেকে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট প্রিপোজিশন, আর্টিকেল, টেনস—সব মুখস্থ করিয়ে দেওয়া হয় যেন আমরা মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাই।
আমি নিজে ইংরেজিতে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ না হতে পারলেও আমাদের অনেক বন্ধু ভালো নম্বর পেয়ে বোর্ডে মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়েছিল। আমি ইংরেজি শেখা শুরু করেছি ওই স্কুল থেকে পাস করে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে।
ইংরেজি সাহিত্যে পড়ালেখা শুরু করে বুঝতে পারলাম, আমার স্কুল-কলেজ আমাকে ইংরেজি শেখাতে পারেনি। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে পড়েও আমরা ভাষাটা শিখিনি। আরও বুঝতে পারলাম যে আমাদের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকেরা আমাদের নতুন করে ইংরেজি ভাষা শেখাচ্ছেন না; তাঁরা ধরেই নিয়েছেন যে আমরা ইংরেজি ভাষা ও ব্যাকরণ জানি ও বুঝি।
আমার নতুন সংগ্রাম শুরু হয়। বই পড়ে, টেলিভিশনে ইংরেজি সিনেমার ডায়ালগ মন দিয়ে শুনে ভাষাটা কিছু রপ্ত করলাম যেন পরীক্ষাগুলো উতরে যাই। কিন্তু খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে আমাদের ইংরেজি সাহিত্য পড়ানো হচ্ছে ঠিকই, তবে ইংরেজিতে লেখা শেখানো হচ্ছে না। খবর নিয়ে জানলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিভাগেই ইংরেজিতে পড়ানো হয়, কিন্তু লেখা শেখানো হয় না।
ঠিক সেই সময়েই যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়ার একটা হিড়িক চলছিল সারা দেশে; আমাদের চেনা প্রায় সবাইই আমেরিকান কালচারাল সেন্টারে গিয়ে টোয়েফল ও স্যাট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেন।
ওই দেশে পড়তে যাই আর না যাই, আমেরিকান সেন্টারে যাওয়া একটা ফ্যাশন হয়ে গেল। না গেলে আর মানসম্মান থাকে না। আমিও সেখানে গেলাম কয়েকবার। গিয়ে বুঝলাম যে ভাষা শেখার একটা নির্দিষ্ট পন্থা আছে, যা সব ভাষা শেখার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই পন্থায় ভাষা শেখানো হয়নি।
সে সময়েই বাংলাদেশে ‘ইংরেজি জানি না’ বলে একটা সামাজিক হাহাকার চলছিল। ইংরেজি যখন একটা আন্তর্জাতিক ভাষায় পরিণত হয়েছে, সেখানে আমরা দুর্বল এবং বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। তাই কেউ কেউ ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেন। সেসব প্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ভাষা খুব সহজেই রপ্ত করে ফেলল, কিন্তু তারা বাংলা ভাষায় পিছিয়ে পড়ল।
ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরাও লিখিত ইংরেজিতে খুব বেশি সার্থকতা পেল না। এই দাবি করছি, কারণ আমি নিজে একসময় একটা ইংরেজি পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের লেখা সম্পাদনা করেছি। তাদের লেখায় অনেক ভুল থাকত।
আমাদের দেশে অদ্ভুত এক ইংরেজিপ্রীতি ও ভালোবাসা আছে। সবাই ইংরেজি শিখবেন—এমন একটা আকাঙ্ক্ষা আছে। যাঁরা ইংরেজি জানেন, তাঁদের মধ্যে একধরনের লক্ষণীয় অহং আছে। যাঁরা জানেন না, তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসে অভাব আছে। যাঁরা অল্প জানেন, তাঁদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলতে না পারার একটা ভয় কাজ করে এবং লেখার সময় তাঁরা নানা রকমের ভুল করেন।
পেশাজীবীদের কথাই চিন্তা করা যাক। চাকরির জন্য সাক্ষাৎকারে বসলে তাঁদের ইংরেজিতে প্রশ্ন শুনতে হয় এবং তা সেই ভাষাতেই উত্তর দিতে হয়। যাঁরা ইংরেজি জানেন না বা কম জানেন, তাঁদের তখন অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। এমন একটা পরিস্থিতি মনে অনেকগুলো প্রশ্নের সম্ভাবনা তৈরি করে। ১২ বছর ইংরেজি শেখার পরও আমরা ইংরেজি জানি না কেন? ইংরেজি ভাষা আমাদের মনে আধিপত্য বিস্তার করে থাকার পরও ইংরেজিতে আমরা কেন এত দুর্বল? আমাদের দেশে বছরে কয়টা ইংরেজি বই প্রকাশিত হয় এবং কতজন পড়েন? ইংরেজিতে লেখা বই সম্পাদনা করার মতো সম্পাদক আমাদের এখানে অপ্রতুল কেন? ইংরেজিতে কথা বলার সময় আমরা সঠিক উচ্চারণ করতে পারছি কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ কেন?
ইংরেজি ভাষায় আমরা যে দুর্বল, তার একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। আমাদের এক বন্ধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের চেয়ারপারসন হয়েছিলেন। তিনি একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন, এখন তাঁর বিভাগের শিক্ষকদের বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিতে হয়; ছেলেমেয়েরা ইংরেজি বোঝে না।
তাহলে এত বছর ধরে ইংরেজি শেখার ফলাফল কী দাঁড়াল? বুঝলাম ইংরেজি ভাষা বাংলাদেশে ব্যর্থ না হলেও এই ভাষা শেখানোর পদ্ধতিগুলো ব্যর্থ। তবে ভাষা হিসেবে ইংরেজি কিন্তু অনেক বেশি সার্থক। আমাদের প্রাত্যহিক বাংলা কথোপকথনে এবং লেখায় প্রায় ৩০ শতাংশ ইংরেজি শব্দ থাকে। আজকাল বাংলা সাহিত্যের গল্প ও কবিতার শিরোনামেও ইংরেজি শব্দ দেখা যায়। আমি নিজেও তা করি।
লেখক: গল্পকার ও যোগাযোগ পেশায় নিয়োজিত।