০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু আয়ানের মৃত্যুর দায় কার?

শরিফুল হাসান
১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১৪:৩৫
ইউনাইটেড হাসপাতালের পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কী দায় এড়াতে পারেন? ছবি: সংগ্রহ

পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু আয়ানের মৃত্যুর দায় কার? ইউনাইটেড হাসপাতালের পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কী দায় এড়াতে পারেন?

এই দেশে বাস বা লঞ্চ দুর্ঘটনায় শত মানুষের মৃত্যুর পর জানা যায় ফিটনেস নেই। ভবনে আগুন লাগার পর জানা যায় যথাযথ অনুমোদন নেই। একইভাবে মানুষের মৃত্যুর পর জানা যায় হাসপাতালের অনুমোদন নেই! আসলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা বা মানুষের মৃত্যুর আগে সব কর্তৃপক্ষ ঘুমিয়ে থাকে।

দুইদিন আগে শিশু আয়ানের মৃত্যুর পর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এখন তারা বলছে, হাসপাতালটির কোনও নিবন্ধন ও লাইসেন্স নেই। এমনকী নিবন্ধন বা লাইসেন্স পেতে প্রতিষ্ঠানটি কখনও আবেদনই করেনি। আচ্ছা, কোনও ধরনের নিবন্ধন ছাড়া কী করে এতদিন চলছিল প্রতিষ্ঠানটি? আপনারা কী সবাই ঘুমাচ্ছিলেন? আর যদি নিবন্ধন ছাড়াই এতদিন চলতে পারে তাহলে আপনারা বাতিলটা করলেন কী?

সাংবাদিক হিসেবে গত দুই দশকে কত যে দুর্ঘটনা আর কতো যে লাশ দেখেছি! এই দেশের প্রত্যেকটা দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর কারণ খুঁজেন। প্রতিটা ঘটনা তদারকের দায়িত্বে নানা কর্তৃপক্ষ আছে! কিন্তু দুর্ঘটনা বা মানুষ মরে যাওয়ার আগে কারও হুঁশ হয় না। বিআরটিএ বলেন, ওয়াসা বলেন, তিতাস বলেন, রাউজক বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেন প্রত্যেকটা সরকারি সেবা সংস্থার বেহাল দশা। দায়িত্ব অবহেলায় কারও শাস্তি হয় না! প্রতিবারই ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়, নানা আলোচনা হয়, তারপর আমরা ফের অপেক্ষা করি নতুন কোনও দুর্ঘটনার!

সুন্নতে খৎনার মতো একটা ঘটনায় কেন একটা শিশুর মৃত্যু হবে? অবাক কাণ্ড দেখেন, আয়ানের মৃত্যুর পর তাঁর বাবার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওই হাসপাতাল হাসপাতাল পরিদর্শন করে জানায়, তাদের নিবন্ধন ও লাইসেন্স নেই। এমনকী নিবন্ধন বা লাইসেন্স পেতে প্রতিষ্ঠানটি কখনও আবেদনই করেনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে আমার প্রশ্ন আপনাদের অনুমোদন ছাড়া কীভাবে চলছিল হাসপাতালটি? আপনাদের কাজ কী তাহলে? আপনাদের এই অপরাধের কোনও শাস্তি কেন হবে না? ওদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, যথাযথ নিয়ম মেনে মুল প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড নামে নিবন্ধন আবেদন করা হয়েছে। মেডিকেল কলেজ চালুর পরই সেখানে চিকিৎসা সেবা দেয়া শুরু হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে আমাদের আবেদন ত্রুটিযুক্ত। কিন্তু আবেদনটি যে ত্রুটিযুক্ত এ বিষয়ে কোনও চিঠি বা নোটিশ আমাদের আগে থেকে দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

জানি না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কী জবাব দেবে। তবে একটা বিষয়ের জন্য নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। অতীতে এই ধরনের ঘটনায় আমরা দেখেছি ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। যেন সব অপরাধ ডাক্তারের। এবার ডাক্তারকে গ্রেপ্তার না করে প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে। আশা করছি নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই ঘটনার গভীরে যাবেন। স্বাস্থ্য খাতে বছরের পর বছর ধরে চলা সমস্যাগুলোর সমাধানের চেষ্টা করবেন।

কয়েকদিন আগে নতুন মন্ত্রীসভা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলাম নতুন মন্ত্রীসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে। বহুবছর আগে থেকে মানুষটাকে চিনি। অসাধারণ একজন মানুষ। পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় পাঁচ শয্যার ছোট একটা ইউনিট থেকে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট তৈরির মূল ব্যক্তি বিশিষ্ট বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জন সামন্ত লাল সেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েই তিনি বলেছেন, এই কাজটি করতে গিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তার টেবিলে টেবিলে ঘুরেছেন তিনি। তাঁর ফাইল ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন কর্মকর্তারা। তিনি বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ (শূন্য সহিষ্ণুতা) দেখাবেন তিনি। সামন্ত লাল সেন বলেছেন, তিনি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবেন। না পারলে নিজেই মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবেন। আমি জানি না তিনি কতটা পারবেন। তবে তাঁর জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা।

এখানে শুধু থাইল্যান্ডের ঘটনা বলি। এই তো গেল মাসেই আমি একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে থাইল্যান্ডে ছিলাম। এর আগেও অনেকবার গিয়েছি দেশটিতে। থাইল্যান্ডের মানুষজনকে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে খুব একটা দুশ্চিন্তা করতে হয় না। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে। যত বড় রোগ হোক, ক্যানসার কিংবা যে কোন অসুখ! মাত্র ৩০ বাথে (বাংলাদেশি ৯০ থেকে ১০০ টাকার) সেখানে সব ধরনের স্বাস্থ্য সেবা মিলবে থাইল্যান্ডে।

অথচ একসময় থাইল্যান্ডের চিকিৎসাব্যবস্থা এমনটা ছিল না। বরং আমাদের মতো বেসরকারি হাসপাতালগুলো ছিল বেশ উন্নত আর সরকারি হাসপাতালগুলো ছিল তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের। এখন সরকার সেখানে ‘থার্টি বাথ হেলথ স্কিম’ চালু করেছে। এই তিরিশ থাই মুদ্রায়, ছোট-বড় সব ধরনের চিকিৎসা সেবা পান নাগরিকেরা। সেটা সর্দিজ্বরের চিকিৎসাও হতে পারে, আবার হার্ট-সার্জারির চিকিৎসাও হতে পারে।

জানি না আদৌ কোনদিন বাংলাদেশে এমনটা হবে কী না। ভীষন আফসোস লাগে! স্বাধীনতার ৫২ বছর হতে চলল। এখানে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা। সুন্নতে খৎনা করতে গিয়ে এই দেশে একটা শিশু মারা যায়। শেষ হয়ে যায় একটা পরিবারের সব স্বপ্ন। এই দেশের স্বাস্থ্যখাত মানেই যেন অনিয়ম আর দুর্নীতি। প্রায়ই গণমাধ্যমে খবরে আসে, কোটি কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। সাধারণ মানুষ চট করে ডাক্তারদের দায়ী করে। কিন্তু গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থাটা যে অনিয়ম দুর্নীতিতে জর্জরিত! খুব করে চাই এই দুরাবস্থা কাটুক। স্বাস্থ্যখাতটা ঠিক হোক!

বিশ্বাস করি, নীতি নির্ধারকের চাইলে, এই দেশের প্রত্যেকটা সমস্যার সমাধান সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সুশাসন। প্রয়োজন জবাবদিহিতা। আপনারা যারা দেশ চালান, আপনারা যারা ক্ষমতাবান, আপনারা যারা নীতি নির্ধারক, আপনাদের কাছে হাতজোড় করে বলি, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুন। জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করুন। আপনাদের দোহাই লাগে জেগে উঠুন!

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট

সর্বাধিক পঠিত