ব্যাপারটা অনেকটা ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা’ টাইপের। প্রথমত, পুরাতন কারিকুলামে কি তেমন কোনও সমস্যা পাওয়া গিয়েছিল যে শতভাগ পরিবর্তন করতে হবে? পুরাতন কারিকুলামের দর্শনটা ঠিক রেখে প্রতি বছর একটু একটু করে পরিবর্তন করে ফাইন টিউন করলেই কিন্তু হতো। হ্যাঁ, নবম দশম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত বিজ্ঞানের সিলেবাস একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। প্রায়োরিটি বিবেচনায় কিছু জিনিস বাদ দেওয়া যেত। সেই ফাইন টিউন আস্তে আস্তে করে যেটা জোরেসোরে করা উচিত ছিল, সেটা হলো আমাদের স্কুলের শিক্ষকদের বেতন ও মানের ব্যাপক উন্নয়ন করা। ভালো মানের ও ডেডিকেটেড শিক্ষক নিয়োগ দিলে পুরাতন সিলেবাসেই অনেক ভালো করার সুযোগ ছিল। ভালো মানের ও ডেডিকেটেড শিক্ষক নিয়োগ দিলে তাঁরাই বোঝানোর জন্য নানা সৃজনশীল পদ্ধতি আবিষ্কার করতেন।
দ্বিতীয় ভালো কাজটি করতে পারতেন সেটা হলো বিভাগ উঠিয়ে দিয়ে ২ থেকে ৩টি বিষয়কে আবশ্যিক করে বাকিগুলোকে অপশনাল করে দিলেই হতো। তাতে ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের বৈষম্যও কমে যেত। ন্যূনতম কয়টি সাবজেক্ট নিতে পারবে সেটা নির্দিষ্ট করে যে কেউ ইচ্ছে করলে তার বেশিও নিতে পারার অপশন রাখতে পারত।
আমরা এই পথে গেলাম না। আমরা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টেরও ধার ধারলাম না। অথচ আমাদের শিক্ষা কমিশনের একটি রিপোর্ট সংসদ কর্তৃক পাস করা আছে। সেটি পছন্দ না হলে নতুন কমিশন করে শিক্ষাবিদদের দিয়ে একটি রূপরেখা তৈরি করে সেই আলোকে শিক্ষাক্রম তৈরি করতে পারতেন। এখন কিছু অধ্যাপক নামের আমলাদের দেখি এই শিক্ষাক্রমের ডুগডুগি বাজাচ্ছেন। উনারা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক?
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়ে এই শিক্ষার্থীরা আমাদের শিক্ষার্থী হয়। আমরা এদের ভোক্তা। আমরা জানি পদার্থবিজ্ঞানে আন্ডারগ্রাজুয়েট করতে হলে প্রিরিকুইজিট কী? কতটা বিজ্ঞান পড়ে আসতে হয় আমরা জানি? পৃথিবীর কোন দেশের কারিকুলামে স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তথ্য-প্রযুক্তি নামক বিষয় পড়ানো হয়? কোন দেশে? নাম জানতে চাই? এই বয়সে তথ্য-প্রযুক্তি শ্রেণিকক্ষে পড়ার দরকার নেই। এই বয়সে দরকার বিজ্ঞান ও গণিতের ফাউন্ডেশন শক্ত করার। এ ছাড়া শিল্প সাহিত্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে এত গুরুত্ব দিতে গিয়ে বিজ্ঞানকে অবহেলা করা হলো। এগুলোকে স্থান করে দিতে বলির পাঁঠা হয়েছে বিজ্ঞান ও গণিত। এটা মানা যায় না।
এই শিক্ষাক্রমের আরেকটি দুর্বল দিক হলো ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও পরীক্ষাকে অবমূল্যায়ন। শিক্ষকদের দিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করানোর দায়িত্ব দেওয়ার আগে যেই মান ও বেতনের শিক্ষক দরকার ছিল সেটা নিশ্চিত না করে এটা পুরোই ব্যাকফায়ার করবে। ধারাবাহিক মূল্যায়ন করতে হলে শিক্ষকদের মেরুদণ্ড শক্ত দরকার, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি দরকার। না হলে এই ধারাবাহিক মূল্যায়নকে ব্যবহার করে প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য আরও জোরেসোরে চলবে।
বলা হচ্ছে নতুন কারিকুলামে নাকি কোচিং বাণিজ্য থাকবে না। কোচিং সেন্টারকে অন্য ব্যবসা খুঁজতে পরামর্শ দিতে বলা হচ্ছে। তারা কি জানে বাংলা মাধ্যমের চেয়ে ইংরেজি মাধ্যমের কোচিং বেশি হয়? আমাদের ইংরেজি মাধ্যমের অনেক শিক্ষার্থী নবম শ্রেণিতে উঠে স্কুল বাদ দিয়ে একদম কোচিং-নির্ভর হয়ে যায়। এর দায় কি ইংরেজি মাধ্যমের কারিকুলাম? স্কুলে যদি ভালো মানের শিক্ষক দেওয়া হয়, স্কুলের শিক্ষকেরা যদি যথাযোগ্য বেতন ও সম্মান পান, তাহলেই কেবল কোচিং বাণিজ্য কমবে। এই সামান্য জ্ঞানটুকু যাদের নেই তারা কীভাবে একটা কারিকুলামকে শতভাগ বদলানোর পরামর্শ দেয়? একটি কারিকুলাম শতভাগ পরিবর্তন যারা করে তাদের ন্যূনতম ধারণাই নেই যে এটা করা ক্রাইম। লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের বছরের পর বছর ধরে ক্ষতি করা ক্রাইম। সেই জন্যই কোথাও এটি করা হয় না। ১০% থেকে ২০% পরিবর্তন করে দেখা হয়। পরীক্ষা ও যাচাইয়ের পর আস্তে আস্তে বাকিগুলো করা হয়।
পৃথিবীর একটি দেশের নাম বলেন তো, যে দেশের কারিকুলাম রাতারাতি শতভাগ বদলে ফেলেছে? আমরা তো শুধু কারিকুলাম না মূল্যায়ন পদ্ধতিও পরিবর্তন করে ফেলছি। বলছি পরীক্ষা থাকবে না। বলছি আনন্দের সাথে লেখাপড়া করবে। মেসেজটা এমন যাচ্ছে যেন পড়ালেখা মানেই চিল করা। প্রশ্ন করতে পারাই হলো সবচেয়ে সেরা শিক্ষা! আবার প্রশ্ন করতে হলে দরকার সৃষ্ট জ্ঞানে সন্দেহ জাগা। নতুন জ্ঞান সৃষ্টির সূচনাও হয় প্রশ্ন ও সন্দেহ দিয়ে! যে বই পড়লে মনে প্রশ্ন জাগায় না বা সন্দেহ সৃষ্টি করে না সেটা কোনও বই নয় বা সেটা কোনও শিক্ষা নয়।
সরকার নতুন যে শিক্ষাক্রম চালু করেছে, সেখানে পরীক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। মানে প্রশ্ন করাকে ডিসকারেজ করা হয়েছে। প্রতিযোগিতা থাকবে না। বলা হচ্ছে পরীক্ষা, নম্বর, ফলাফল, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি নাকি অসুস্থতা। এর চেয়ে আজগুবি কথা আর হয় না! টিকে থাকা মানেই হলো প্রতিযোগিতা! প্রতিযোগিতা মানেই নিজেকে উন্নত করা। এটাকেই বলে ‘survival of the fittest’, অথচ এটাকেই অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। খুব বেশি দিন আগের কথা না, আমাদের ওপর পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা নাজিল করে আমাদের বলা হচ্ছিল পরীক্ষা খুব ভালো জিনিস। এখন বলা হচ্ছে পরীক্ষা ভালো না! এসব বাদ দিন।
লেখক : অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।