১৮ অক্টোবর ২০২৪
ইউরো ২০২৪

বিশ্ব ফুটবলের বিস্ময় ১৬ বছরের এক কিশোর, কে এই লামিনে ইয়ামাল?

কিশোর ডাইজেস্ট ডেস্ক
১০ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৪
বিশ্ব ফুটবলের এক বিস্ময় লামিনে ইয়ামাল। ছবি: সংগৃহীত

অনেকে বলাবলি করছিলেন, স্পেনের জাতীয় দলে এখন আর বড় তারকা নেই, কাগজে-কলমে হেভিওয়েট স্কোয়াডও নেই। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ শুরুর আগে স্পেন দলে ছিল শুধু না থাকার হাহাকার। অথচ জার্মানি, ফ্রান্সকে টপকে ফাইনালে উঠে গেল স্পেন। তারুণ্যের শক্তিতে উজ্জীবিত দলটা এবারের টুর্নামেন্টে নিজেদের নতুন করে চেনাল, সবশেষ ম্যাচেও ফ্রান্স হেরেছে দুই উদীয়মান স্প্যানিশ তারকার কাছেই। বর্তমান স্প্যানিশ দলের সেরা তারকা ১৬ বছরের এক কিশোর, শুধু স্পেন নয়, বিশ্ব ফুটবলের যেন এক বিস্ময়, তাঁর নাম লামিনে ইয়ামাল। 

লামিনে ইয়ামালের কাঁধগুলো এখনো পুরোপুরি শক্ত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এই কিশোরের কাঁধে ভর করেই ছুটছে স্পেন, সেমিতে পিছিয়ে পড়েও তাঁর কল্যাণে সমতায় ফিরতে পেরেছিল তাঁরা। এছাড়া ড্রিবলিং আর থ্রু পাসে ফরাসি রক্ষণের কঠিন পরীক্ষা নিয়েছেন তিনি। আধিপত্য দেখানো ম্যাচে শেষপর্যন্ত ২-১ গোলে জিতে ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে তাঁর দল।

২০১৪ সালে মাত্র ৭ বছর ফুটবল পায়ে জড়িয়ে যাত্রাটা শুরু করে ইয়ামাল। বার্সার বয়সভিত্তিক দলের সঙ্গে শুরু করে অনুশীলন। তারপর শুধু তাঁর এগিয়ে চলার গল্প। স্পেনের বয়সভিত্তিক দলের হয়ে প্রতিভার পরিচয় দেওয়া ইয়ামালকে ছোট বয়সেই জাতীয় দলের হয়ে খেলার প্রস্তাব দিয়েছিল মরক্কোর ফুটবল সংস্থা। ইয়ামাল বেছে নিয়েছেন নিজের জন্মভূমিকে। স্পেনের জল-হাওয়ার সঙ্গে তাঁর পরিচয় জন্ম থেকে। নিজেকে স্পেনীয় ভাবতেই পছন্দ করেন। বাবা-মায়ের মিশ্র সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা ‘উদ্বাস্তু’ ইয়ামালকে নিজের করে নিতে দু’বার ভাবেনি স্পেনও।

বিশ্ব ফুটবলের এক বিস্ময় লামিনে ইয়ামাল। ছবি: সংগৃহীত

মাত্র ১৬ বছরের কিশোর ইয়ামালকে এত দিন সকলে বলতেন দুর্দান্ত প্রতিভা। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইউরো সেমিফাইনালে সেই প্রতিভার ঝলক দেখল ফুটবল বিশ্ব। গোল করলেন। বার বার সুযোগ তৈরি করলেন। ইউরোর ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হওয়ার নজির গড়লেন। এই সবের সঙ্গেই বুঝিয়ে দিলেন, শুধুমাত্র প্রতিভা হয়ে থাকতে আসেননি। আগামী বেশ কয়েক বছর শাসন করতে চান ফুটবল বিশ্বকে।

ফুটবলজীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে লিয়োনেল মেসি। তাঁর অবসরের আগেই বিশ্বফুটবলকে বার্সেলোনার উপহার ইয়ামাল। মেসির মতোই বার্সেলোনার অ্যাকাডেমি লা মাসিয়ায় ফুটবলে পায়ে খড়ি স্পেনের ১৬ বছরের উইঙ্গারের। স্পেনের অনূর্ধ্ব ১৫, ১৬, ১৭, ১৯ সব দলের হয়ে খেলেছেন। জাতীয় দলের হয়েও খেলে ফেললেন ১৩টি ম্যাচ।

শুধু ভাল ফুটবলার নন, ফুটবলের জাদুকর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে ইয়ামালের মধ্যে। ইউরো সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তাঁর গোলই প্রমাণ। ম্যাচের বয়স তখন ২১। ফ্রান্সের বক্সের বাইরে বল পান ১৬ বছরের ফুটবলার। প্রতিপক্ষের দুই ডিফেন্ডারকে নাস্তানাবুদ করেই গোলের গন্ধ পেয়ে যান। তাঁর বাঁ পায়ের বাঁক খাওয়ানো শট আটকাতে পারেননি ফ্রান্সের গোলরক্ষক মাইক মাইগানান। তিনি আসলে কোনও সময়ই পাননি। বড় ফুটবলারেরা বোধ হয় এমনই হন। আপাত সাধারণ পরিস্থিতিকে গোলের সুযোগে পরিণত করতে পারেন। মাঠে নিজের এবং অন্য ফুটবলারদের অবস্থান মুহূর্তে জরিপ করে ম্যাচের রং বদলে দিতে পারেন। মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোদের সঙ্গে তুলনা করার মতো জায়গায় এখনও আসেননি। কয়েক বছরের মধ্যে সেই জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে পারেন ফুটবলের নতুন বিস্ময়।

ইয়ামালের জন্ম ২০০৭ সালের ১৩ জুলাই কাতালুনিয়ান শহরের মাতারোয়। তাঁর বাবা মরোক্কান এবং মায়ের বাড়ি গিনি। দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা।  জন্মের পর থেকে তাঁর জীবন সহজ ছিল না। বিভিন্ন সময় তাঁর পরিবারকে বাস বদলাতে হয়েছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই বিকশিত হয়েছে তাঁর ফুটবল প্রতিভা। সাত বছর বয়সে লা মাসিয়ায় যাওয়ার আগেই ফুটবলার ইয়ামালকে চিনে ফেলেছিল মাটারার অলিগলি। পাড়ায় পাড়ায় ‘সেভেন এ সাইড’ ফুটবল খেলতেন তিনি। খেলতেন বড়দের সঙ্গেই। ২০১৪ সাল থেকে বার্সেলোনায় স্থায়ী ভাবে থাকতে শুরু করে ইয়ামালের পরিবার। তখন তাঁকে ভর্তি করানো হয় বার্সেলোনার ফুটবল অ্যাকাডেমিতে। সেখানেও প্রথম থেকেই নজর কেড়ে নেয় তাঁর প্রতিভা।

ইয়ামালের পেশাদার ফুটবলজীবন শুরু ২০২৩ সালে। সবেই শুরু করেছেন। বলা যায় ফুটবলজীবনের চৌকাঠ পেরিয়েছেন সবে। চৌকাঠে দাঁড়িয়েই যে কেরামতি দেখাচ্ছেন, তাতে নিশ্চিতভাবে বহু জাদু দেখাবে তাঁর বাঁ পা। বাঁ পায়ের ফুটবলারদের খেলা একটু বেশিই নান্দনিক হয়। ইয়ামালও ব্যতিক্রম নন।

গত ইউরো কাপের সময় ইয়ামালের বয়স ছিল ১৩। সেমিফাইনালে ইটালির কাছে হেরে গিয়েছিল স্পেন। বন্ধুদের সঙ্গে শপিং সেন্টারে দাঁড়িয়ে ইয়ামাল দেখেছিলেন দেশের হার। টাইব্রেকারে প্রথম শটে গোল করতে পারেননি ডানি ওলমো। ম্যাচের সেরা ফুটবলার হয়েও দেশকে কাঙ্খিত জয় এনে দিতে পারেননি। তখন থেকেই ইয়ামাল স্বপ্ন দেখতেন দেশকে ইউরো কাপ জেতানোর।

এ বারের ইউরো খেলতে এসে সমস্যা পড়েছেন ইয়ামাল। জার্মানির শিশুশ্রম আইনের কবলে পড়তে হয়েছে তাঁকে। ৯০ মিনিট তাঁকে মাঠে রাখা যাচ্ছে না। স্পেনের কোচ লুইস ডে লা ফুয়েন্তে তাঁকে তুলে নিচ্ছেন সুযোগ মতো। জার্মানির শিশুশ্রম আইন অনুযায়ী, নাবালকদের স্থানীয় সময় রাত ৮টার পরে কাজ করানো বেআইনি। খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে সময়সীমা রাত ১১টা পর্যন্ত। যে সময় খেলা শুরু হচ্ছে, তাতে পুরো ৯০ মিনিট খেলালে জার্মানির আইন অনুযায়ী ম্যাচ প্রতি ২৭ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে স্পেনকে। এই কড়া আইনও রুখতে পারছে না তাঁকে। সেমিফাইনালে যেমন পারল না কিলিয়ান এমবাপের ফ্রান্স। যদিও ফুয়েন্তে জানিয়ে দিয়েছিলেন, প্রয়োজন মনে করলে পুরো ম্যাচই খেলাবেন ইয়ামালকে। জরিমানা দিতে হলে দেবেন। আইনে তোয়াক্কা করবেন না। আইনের প্যাঁচে ফেলে তাঁর সেরা অস্ত্রকে ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা সফল হতে দেবেন না।

গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলিতে গোল করতে পারেননি ইয়ামাল। গোল পাননি নক আউট পর্বের প্রথম দু’ম্যাচেও। ১৬ বছরের ফুটবলার খেলতে পারছিলেন না এমন নয়। দলের সাফল্যে ধারাবাহিক ভাবে অবদান রাখছিলেন তিনি। গোল করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছিলেন সতীর্থদের। প্রতিপক্ষের রক্ষণকে বোকা বানাচ্ছিলেন। যা যা করা সম্ভব সব করছিলেন। সেমিফাইনালে নিজে গোল করলেন। গত বার শেষ চারের বাধা টপকাতে ব্যর্থ স্পেনকে তুলে দিলে ফাইনালে।

গত বার টাইব্রেকারে গোল করতে না পারা ওলমো এ বারও দলে আছেন। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দলের দ্বিতীয় গোলটি তাঁরই। ওলমোর পাশে খেলেই ইয়ামাল বুঝিয়ে দিলেন তিনি আলাদা। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি আর ফুটবল দক্ষতাকে টক্কর দেওয়া কঠিন। বেশ কঠিন। স্পেনের দু’টি গোল হয়েছে চার মিনিটের তফাতে। ২১ মিনিটে সমতায় ফেরান ৯ মিনিটের মাথায় কোলো মুয়ানির গোলে পিছিয়ে পড়া স্পেনকে। ২৫ মিনিটে ওলমোর পা থেকে এসেছে দ্বিতীয় গোল। তাতে আরও স্পষ্ট হয়েছে পার্থক্য।

১৬ বছর ৩৬২ দিনের ইয়ামাল স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। নিজের ১৭তম জন্মদিনে স্পেনকে ইউরো চ্যাম্পিয়ন করার। প্রতিযোগিতার মাঝেই স্কুলের পরীক্ষা দিয়েছেন। অনুশীলন, ম্যাচ খেলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়াশোনাও করতে হয়েছে। পাশও করেছেন পরীক্ষায়। ইউরোর নকআউটের আগে পরীক্ষার ফল স্বস্তি দিয়েছিল ১৬ বছরের ফুটবলারকে। আরও একটা পরীক্ষায় পাশ করতে চান। আগামী রবিবার ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরীক্ষায়। স্পেনের কাণ্ডারি যদি ফাইনালের পরীক্ষা পাস করেন, তবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

খুব বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন না ইয়ামাল। নিজের মতো থাকতে ভালবাসেন। আর পাঁচ জন সাধারণ কিশোরের মতো অবসর সময় ভিডিয়ো গেম খেলেন। তবে মাঠে নামলে কথা বলে তাঁর পা। সক্রিয় ফুটবল মস্তিষ্ক মুহূর্তে সংকেত পাঠায় কী করতে হবে। চোখ খুঁজে নেয় সতীর্থদের অথবা গোল। ইয়ামাল বলেছেন, ‘‘সেমিফাইনালে জয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি। প্রথম থেকে আমার লক্ষ্য ছিল, জার্মানিতে জন্মদিন পালন করার। মাকে বলে এসেছি, ফাইনালে জিতলে আমার জন্য কোনও উপহার কিনতে হবে না। এ বারের জন্মদিনটা সতীর্থদের সঙ্গেই উদ্‌যাপন করতে চাই।’’

সমাজমাধ্যমে দাবা বোর্ডের ছবি দিয়ে ইয়ামাল লিখেছেন, ‘‘চুপচাপ এগিয়ে চল। শুধু চেকমেট হওয়ার সময় কথা বল।’’ কথা বলছে ইয়ামেলের বাঁ পা। কথা শুরু হয়েছে ফুটবল আলোচনাতেও। কোপা আমেরিকায় ব্যস্ত মেসিও নিশ্চয়ই নজর রাখছেন। পাশাপাশি সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরাও নজর রাখছেন এই কিশোরের প্রতি।

সর্বাধিক পঠিত