ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবেই জাতীয় দলে জায়গা পেয়েছিলেন অলক কাপালি। লেগ স্পিনটাও রপ্ত ছিল তার। তবে তখনও নিয়মিত বোলার হয়ে উঠেননি তিনি। মাঝেমধ্যেই ব্রেক থ্রো আনতে হলেই অধিনায়কেরা শরনাপন্ন হতেন তার কাছে। তেমনি ২০০৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে পেশোয়ারে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে তৎকালীন অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন তার হাতে তুলে দেন বল। লক্ষ্য একটাই মোহাম্মদ ইউসুফের উইকেট আদায় করা।
প্রথম চার বলে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তবে শেষ দুই বলেই করলেন বাজিমাত। শাব্বির আহমেদ ও দানেশ কানেরিয়ার উইকেট তুলে নেন। তাতে জেগে উঠে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা। পরের ওভারের প্রথম বলে উইকেট নিলেই হয়ে যাবে সেটা। কিন্তু তখনও ক্রিজে টিকেছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ। তবে ওভার যখন শেষ হলো, তখন উমর গুল এলেন স্ট্রাইকে। অলকের রিস্ট স্পিনে কাঁবু হলেন গুল। সিলেটের ছেলে অলকের হাত ধরে বাংলাদেশ পেয়ে যায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম হ্যাটট্রিক।
দিনটি ছিল ২৯ আগস্ট। আজ সেই কীর্তির ২১ বছর পূর্তির দিন। দিনটির কথা স্মরণ হলে কেমন বোধ করেন জানতে চাইলে বলেন, ‘যেকোনো কীর্তিই আনন্দ দেয়। ভোলার নয়, প্রথম আন্তর্জাতিক হ্যাটট্রিক, সেটাও আবার দেশের প্রথম। সবকিছু মিলিয়ে এটা অনেক গর্বের একটা মুহূর্ত। সেদিন ছেলে এসে বললো, পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে প্রথম হ্যাটট্রিক কার। তোমার নাম লিখেছি, সঙ্গে তার বন্ধুরাও বলে আজ আঙ্কেলের নাম লিখেছি। এসব শুনলেও অনেক ভালো লাগা কাজ করে।’
হ্যাটট্রিকের পরিকল্পনা সাধারণত বোলারদের থাকে না, এটা আসলেই হয়ে যায়। তবে আসলেই কি তাই? অলকের ভাবনাতেও কি হ্যাটট্রিক ছিল না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে সুজন ভাই (খালেদ মাহমুদ) আমার কাছে এসে বল দিয়ে বলেন, একটা ব্রেক থ্রো এনে দিতে। যেহেতু ঐ ম্যাচে আমি নিয়মিত বোলার ছিলাম না। আর মোহাম্মদ ইউসুফ টিকেছিল, ওর উইকেট নিলেই বাকি থাকত দুই উইকেট। লিড নেওয়া সহজ হয়ে যেত। সেই ভাবনা থেকেই আমাকে বোলিংয়ে এনেছিলেন তিনি।’
অলক যোগ করেন, ‘তখনও আমার ভাবনায় হ্যাটট্রিক ছিল না। একটা ব্রেক থ্রো এনে দেওয়াই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু শেষ দুই বলে যখন পরপর শাব্বির আর কানেরিয়ার উইকেট তুলে নিলাম, তখনই ভাবনায় এলো এটা আমাকে করতেই হবে। যেহেতু পরের ওভারে, তাই একটু সময়ও পেলাম। আমি খুব করে চাইছিলাম ইউসুফ যেন স্ট্রাইকে না আসে। আর হলোও তাই। তার মধ্যে সুজন ভাই আর পাইলট ভাই (খালেদ মাসুদ) এসে আত্মবিশ্বাস দিলেন। সঙ্গে বাকি সিনিয়ররাও, আর বল করতেই এলবিডব্লিউ হয় গুল। সেই সময়ের মুহূর্তটা এখনও চোখে ভাসছে।’
টেস্ট ক্রিকেটে পর্দাপনের দুই যুগে এসে পাকিস্তান বধ করেছে বাংলাদেশ। রাওয়ালপিন্ডিতে ১০ উইকেটের জয়টা মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের মতোই ঐতিহাসিক। তবে তারও ২১ বছর আগে দুই বার পাকিস্তানকে হারানোর সম্ভাবনা জাগিয়েছিল লাল-সবুজের জার্সিধারীরা। ২০০৩ সালের সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচ মুলতান টেস্টের কথা তো সবারই জানা। তবে তার আগের ম্যাচ পেশোয়ারেও জয়ের পথ তৈরি হয়েছিল। যে ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন অলক।
সেই ম্যাচে বাংলাদেশ আগে ব্যাট করে ৩৬১ রান করে। ৩ রানের জন্য হাবিবুল বাশার সেঞ্চুরি বঞ্চিত হলেও জাবেদ ওমর বেলিম ১১৯ রান করেই মাঠ ছেড়েছিলেন। সেই রান তাড়ায় নেমে পাকিস্তান থামে ২৯৫ রানে। যার মধ্যে শেষ তিনটি উইকেট ছিল কাপালির হ্যাটট্রিক। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে নিজেদের ব্যাটিং সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি মাত্র ৯৫ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল। স্বাগতিকরাও ম্যাচটা ৯ উইকেটের বড় ব্যবধানে জিতে নেয়। তবে প্রাপ্তি হিসেবে যোগ হয়েছিল, প্রথম কোনো দলের বিপক্ষে লিড।
সেটা স্মরণ করে অলক বলেন, ‘আসলে আমাদের সামনে সুযোগ এসেছিল প্রথমবারের মতো টেস্টে কোনো দলের বিপক্ষে লিড নেওয়ার। আমরা সেটাই কাজে লাগিয়েছি। আসলে আমাদের সিনিয়র এবং জুনিয়রদের সমন্বয়ে যে দলটা ছিল, সেটা ছিল দুর্দান্ত। আমি, মাশরাফী, আশরাফুলসহ অনেকেই ছিলাম দলের জুনিয়র সদস্য। তবে সুজন ভাই, পাইলট ভাই আমাদেরকে সবসময় আত্মবিশ্বাস জোগাতেন। আমরাও যে পারব সেই আস্থা তারা রাখতেন, আমরাও তাই প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা জিততে পারিনি। ২০২৪ সালে নয়, প্রথম জয়টা সেবারই আসতে পারত। হয়তোবা সিরিজও জিততে পারতাম। অভিজ্ঞতার ঘাটতি, নিজেদের ভুল আর আম্পায়ারদের কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের সেটা হতে দেয়নি।’
বাংলাদেশ দল রাওয়ালপিন্ডিতে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নামবে আগামীকাল। সেই ম্যাচের আগে পাকিস্তান হার থেকে শিক্ষা নিয়ে দলে এনেছে পরিবর্তন। প্রথম ম্যাচে চার পেসার খেলালেও ছিলেন না কোনো বিশেষজ্ঞ স্পিনার। শেষ ম্যাচে তারা দলে এনেছে লেগ স্পিনার আবরার আহমেদকে। কিন্তু বাংলাদেশ দলে নেই কোনো রিস্ট স্পিনার। তাই প্রথম টেস্টের মতো দ্বিতীয়টি সহজ হবে না।
তবে অলকের আস্থা আছে তাইজুলদের ওপর। বললেন, ‘আমাদের দলের স্পিনাররা দারুণ। সাকিব ফর্মে ফিরছে। মিরাজও দুর্দান্ত বল করেছে। তাছাড়া তাইজুলও অন্যতম ভরসা। আমার বিশ্বাস তারা প্রথম ম্যাচের সাফল্য ধরে রাখতে পারবে।’
বাংলাদেশ একটা সময়ের স্পিননির্ভর ক্রিকেট দেশ হলেও কখনও সেভাবে উঠে আসেননি কোনো লেগ স্পিনার। মোহাম্মদ আশরাফুল ও অলকরা থাকলেও তারা দ্যুতি ছড়িয়েছেন ব্যাট হাতে। এখনও সেভাবে স্বীকৃত লেগ স্পিনারের সংখ্যাও বাড়েনি। অলক তাই মনে করেন রিশাদ হোসেনের মতো আরও প্রতিভা খুঁজে বের করা প্রয়োজন, ‘আমাদের অনেক দেরি হলেও লেগ স্পিনার হান্ট শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে। ক্লাবগুলোতে নিয়মিত একাদশে রিস্ট স্পিনারদেরও জায়গা করে দিতে হবে। তবেই আমরা আরও প্রতিভা খুঁজে পাবো।’
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন বছর দুয়েক আগে। সেটাও তার ঐতিহাসিক হ্যাটট্রিকের দিন ২৯ আগস্টে। তবে এখনও ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগের নিয়মিত মুখ তিনি। খেলে যাচ্ছেন প্রাইম ব্যাংকের হয়ে। সবশেষ আসরেই সবধরণের ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে শেষদিকে এসে ক্লাবটির পক্ষ থেকে আরও এক মৌসুম খেলার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সঙ্গে দলটির কোচ হিসেবেও ভূমিকা রাখতে বলা হয়েছিল তাকে। তাই আগামী মৌসুমে দলটির কোচ ও ক্রিকেটার হিসেবে দেখা যাবে তাকে।
তাহলে কি কোচিংয়েই পরবর্তী ক্যারিয়ার গড়তে যাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে এটা এখনও জানি না। আমার চেয়ে অনেক জুনিয়র ক্রিকেটাররাও এখন কোচ হয়ে ভালো করছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কতটা এগিয়ে নিতে পারব জানি না। তবে অপশন তো আছে অনেক। যেখানে ভালো সুযোগ পাব, সেখানেই ক্যারিয়ার গড়ব।’
চোট জর্জর ক্যারিয়ার তার খুব বেশিদূর এগোয়নি। জাতীয় দলের জার্সিতে ১৭ টেস্টে আছে মাত্র ৬ উইকেট। রান ৫৮৪, সর্বোচ্চ ৮৫। অন্যদিকে ৬৯ ওয়ানডেতে ১২৩৫ রান, সর্বোচ্চ ১১৫। উইকেট আছে ২৪টি। ৭ টি-টোয়েন্টিতে রান মাত্র ৫৭, সর্বোচ্চ ১৯। উইকেট সংখ্যাও মাত্র দুটি।