
কিছু কিছু নিন্দুক বলে, বয়স কমানো হয়েছে ওর। কাগজে-কলমে ওর বয়স ১৪ বছর ৩২ দিন। বয়স কমালে কতই বা কমিয়েছে? দুই বছর? তবু তো ১৬! ওই বয়সেই আইপিএলের রেকর্ড এলোমেলো করে দেওয়া এক সেঞ্চুরি করল রাজস্থান রয়েলসে খেলা এক কিশোর ক্রিকেটার।
আইপিএলে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই প্রথম বলেই হাঁকিয়েছিল ছক্কা, গড়েছিল ৩ বিরল রেকর্ড। তারপর তৃতীয় ম্যাচে করল ডাপূটে সেঞ্চুরি, গড়ল দারুণ সব রেকর্ড। ক্রিকেট-বিশ্ব বিস্ময় ভরে শুধু তাকিয়ে দেখল, বারবার বলল, এ তো বিস্মিয়! এ তো বিস্ময়!
বিস্ময়কর ক্রিকেটারটির নাম বৈভব সূর্যবংশী। যেন রেকর্ডের বরপুত্র, যেন ক্রিকেটের আর্শীবাদ!
ম্যাচটি ছিল কঠিন, ম্যাচটি বাঁচা-মরার। খেলায় হারলে রাজস্থান রয়্যালসকে ছিটকে পড়তে হবে প্লে অফে ওঠার দৌড় থেকে। ম্যাচে প্রতিপক্ষ আগে ব্যাটিংয়ে নেমে তুলেছে ৪ উইকেটে ২০৯ রান। রাজস্থানের ওপর চাপটা তাই অনেক বেশি ছিল। কিন্তু সেটা নাটকের প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় অর্থাৎ শেষ পর্ব যে এতটা জমজমাট হবে, তা কে জানত!
১৪ বছর বয়সী এক ছেলের ব্যাটের স্রেফ আগুন ঝরল, সেই আগুনের উত্তাপে রাজস্থানের ওপর জেঁকে বসা সব চাপ–টাপও যেন উবে গেল! কেউ কেউ বলছেন, বৈভব সূর্যবংশীর ব্যাটে আইপিএলের ইতিহাসেই অন্যতম অবিশ্বাস্য এক ইনিংসের জন্ম হলো!
১১ ছক্কা ও ৭ চারে ৩৮ বলে ১০১ রানের ইনিংস খেলা বৈভব ১১.৫ ওভারে যখন গুজরাট টাইটানসের পেসার প্রসিদ্ধ কৃঞ্চার বলে আউট হলো, জয়ের জন্য ৪১ বলে রাজস্থানের প্রয়োজন ৫২ রান। হাতে ৯ উইকেট। রানের পাহাড় ডিঙিয়ে জয় তুলে আনার খুব কঠিন কাজটা মাত্র ১৪ বছর ৩২ দিন বয়সী বৈভবের ব্যাটে রাজস্থানের জন্য ততক্ষণে সহজ হয়ে এসেছে। যশস্বী জয়সোয়াল ও রিয়ান পরাগের তৃতীয় উইকেটে ২০ বলে ৪১ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে রাজস্থান শেষ পর্যন্ত জিতেছে ৮ উইকেটে, ২৫ বল হাতে রেখে।
দুই শর বেশি রান তাড়া করতে নেমে ৪ ওভারের বেশি বল হাতে রেখে রাজস্থানের এই দুর্দান্ত জয়ের শিরোনাম হতে পারে একটাই—বৈভবের আগুনে পুড়ল গুজরাট। তা নয় তো কী! ইনিংসের তৃতীয় বলে ছক্কা মেরে খুলেছে নিজের রানের খাতা। ইশান্ত শর্মার করা চতুর্থ ওভারে ওঠা ২৮ রানের ২৬ এসেছে বৈভবের ব্যাট থেকে। ফিফটি তুলেছে ১৭ বলে, যেটা আইপিএলের এ মৌসুমে দ্রুততমও।
১০ম ওভারে গুজরাট পেসার করিম জানাতের কাছ থেকে একাই তুলেছে ৩০ রান। পরের ওভারেই দ্বিতীয় বলে রশিদ খানকে ছক্কা মেরে আইপিএলের ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি তুলে নিল বৈভব। ৩৫ বলে ১০০! আইপিএলে বৈভবের চেয়ে কম বলে সেঞ্চুরি আছে শুধু ক্রিস গেইলের। ২০১৩ সালে পুনে ওয়ারিয়র্সের বিপক্ষে ৩০ বলে। তারপর এই এক যুগে গেইলের মতো বিস্ফোরক ইনিংসের কাছাকাছি কেউ যেতে পারেননি, যেটা আজ পারল কি না এক ১৪ বছর বয়সী!
শুধু কী তাই, এই ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে নিজের তৃতীয় খেলতে নামা বৈভব এখন আইপিএলের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান। ২০০৯ সালে ১৯ বছর ২৫৩ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করা মনীশ পাণ্ডের রেকর্ডটি এখন বৈভবের। ছেলেদের টি–টোয়েন্টিতে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে সেঞ্চুরির রেকর্ডও এখন তার। ২০১৩ সালে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে ১৮ বছর ১১৮ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করা ভিজয় জোলের রেকর্ডটি এখন বৈভবের।
গুজরাটের বোলারদের জন্য আজকের ম্যাচটি স্রেফ ভুলে যাওয়ার। ওপেনিং জুটিতেই ১৬৬ রান তুলেছেন বৈভব ও জয়সোয়াল। ৪০ বলে ৭০ রানে অপরাজিত জয়সোয়াল শেষ পর্যন্ত ছিলেন। ২ ছক্কা ও ৯ চারে ১৭৫ স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করা জয়সোয়ালকেও বৈভবের সামনে কেমন ম্লান লেগেছে। কারণ বৈভবের ইনিংসের স্ট্রাইকরেট যে ২৬৫.৭৮! ভারতের বিশ্বকাপজয়ী সাবেক ক্রিকেটার যুবরাজ সিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইয়ান বিশপের সেই কথাটা স্মরণ করে তাই লিখেছেন, ‘বৈভব সূর্যবংশী—রিমেম্বার দ্য নেম!
সপ্তাহখানেক আগে বৈভবের যখন আইপিএলে অভিষেক হয়, তখন খেলে নেমেই গড়েছিল ৩ রেকর্ড।
রেকর্ড নম্বর ১
প্রথম রেকর্ডটি বয়সেরই। আইপিএলে সবচেয়ে কম ১৪ বছর ২৩ দিন বয়সে অভিষেকের রেকর্ড এখন সূর্যবংশীর। পেছনে ফেলেছে ২০১৯ সালে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে ১৬ বছর ১৫৭ দিনে নামা প্রয়াস রয় বর্মণকে।
রেকর্ড নম্বর ২
সূর্যবংশী অভিষেকে প্রথম বোলার হিসেবে পেয়েছে শার্দুল ঠাকুরকে। ভারতের হয়ে ৮৩টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা এই পেসারের মুখোমুখি হয়ে প্রথম বলকেই কাভারের ওপর দিয়ে ছয় মারে সূর্যবংশী।
আইপিএলে সবচেয়ে কম বয়সে ছক্কা মারার রেকর্ডও এখন তারই। এত দিন রেকর্ডটা ছিল রিয়ান পরাগের, যিনি প্রথম ছক্কা মেরেছিলেন ১৭ বছর ১৬১ দিন বয়সে। আবার সবচেয়ে কম বয়সে চারের রেকর্ডও সূর্যবংশীর। যেটা ছয় বছর ধরে ছিল প্রয়াসের নামে।
রেকর্ড নম্বর ৩
আইপিএল ক্যারিয়ারের প্রথম বলেই ছক্কা—এটিও রেকর্ড। তবে এ রেকর্ডে সূর্যবংশীই প্রথম নন। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার রব কুইনি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কেভন কুপার, আন্দ্রে রাসেল, জাভোন সিয়ারলেস ও কার্লোস ব্রাফেট, ভারতের অনিকেত চৌধুরী, সিদ্ধেশ লাড ও সামির রিজভী এবং শ্রীলঙ্কার মহীশ তিকশানাও একই কীর্তি গড়েছিলেন।
২০ বলে ২ চার ও ৩ ছক্কায় ৩৪ রান—ইনিংসটা অনেক লম্বা হয়নি। তবে শুরুতেই একাধিক রেকর্ডে নাম লিখিয়ে দৃষ্টি নিজের দিকে টেনে নিয়েছে সূর্যবংশী।