০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
মন কেমনের সুন্দরবন : পর্ব ১

সুবর্ণ বছরে সুন্দরবন যাত্রা

ফারুক সুমন
০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬:৩৫
মন কেমনের সুন্দরবন। অলংকরণ : কিশোর ডাইজেস্ট

মাঝেমাঝে কোনও কারণ ছাড়াই আমরা স্তব্ধ হয়ে থাকি—যাকে বলে ঘোরগ্রস্ত আত্মমগ্ন সময়। নিজের মনবাগানের ফুল দিয়ে সন্তর্পণে নিজেই মালা গাঁথি। তবে স্তব্ধ হয়ে থাকার কারণ যে একেবারেই নেই তা নয়। হয়তো সে কারণ ব্যাখ্যাতীত। ভাষায় নয়; কেবল কল্পনায় ডুব দিয়ে অনুভবের থইথই সরোবরে সাঁতার কাটতেই তখন বেশি ভালো লাগে। সুন্দরবন ভ্রমণ শেষে আমার মনেও ভর করেছে স্তব্ধ সময়। মন কেমন করা আবেশে বুঁদ হয়ে আছি। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ঠিকই বলেছেন, ‘ভ্রমণ প্রথমে আমাদের নির্বাক করে দেয়। তারপর গল্প বলতে বাধ্য করে।’

হ্যাঁ, সুন্দরবন থেকে বেড়িয়ে এসে আমিও যেন নির্বাক হয়ে আছি। চোখে ভাসে বিস্তীর্ণ জলরাশি। ঘন অরণ্যের কোমর ছুঁয়ে আছড়ে পড়ছে মৃদুমন্দ ঢেউ। হঠাৎ হঠাৎ কানে বাজে নাম না জানা পাখির তান। নিসর্গের নিবিড় নৈকট্য পেয়ে এক অভূতপূর্ব অনুভব আমাকে যেন অবশ করে রেখেছে। এত দিন সুন্দরবন সম্পর্কে লোকমুখে কিংবা বইয়ের পাতায় যেসব গল্প পড়েছি, বাস্তবের সুন্দরবন যেন তার চেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর। মনে ও ধ্যানে সঞ্চারিত করে আধ্যাত্মিক সুন্দর।

২০২১-এর ডিসেম্বর মাসের ২৬ তারিখ ছিল আমাদের শুভযাত্রা। পৌষের মাঝামাঝি বিধায় শীত-শীত আবহে ৮০ জনের কাফেলা বের হয়েছি। অবশ্য মাস তিনেক আগে থেকেই চলছে প্রস্তুতি। বলে নেওয়া ভালো, এই কাফেলার সবাই আমার সহকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্য। আমাদের অধ্যক্ষ মহোদয় যাওয়ার কথা থাকলেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকায় যেতে পারেননি। তাঁর অনুপস্থিতিতে এই বিশাল কাফেলার কাণ্ডারির দায়িত্ব পালন করেছেন উপাধ্যক্ষ স্যার। আমরা দেখেছি, উৎকণ্ঠায় থেকেও কী তুমুল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। আগেই খুলনা গিয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করে এসেছেন। উপর্যুপরি জুম মিটিং করে সার্বিক বিষয়ে সবার সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।

বাসে যাব, নাকি ট্রেনে—এই নিয়ে ভোটাভুটি হয়। মজার ব্যাপার, প্রায় সবাই রেলভ্রমণের পক্ষেই মত দিলেন। সন্দেহ নেই, রেলভ্রমণ তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও আরামদায়ক। কিন্তু একসঙ্গে একই কামরায় ৮০টি টিকেট জোগাড় করা কঠিন বৈকি। উপাধ্যক্ষ স্যার নাছোড়বান্দা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, তিনি তাঁর সহকর্মীদের ট্রেনে নেবেন বলে পণ করেছেন। ফলে, যখন সবাই টিকেট পাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন, তখন মিটিং-এ বারবার তিনি এই বলে আশ্বস্ত করেছেন, ‘আমি আশাবাদী মানুষ। টিকেট হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’ শেষমেশ তা-ই হলো। স্যার ঘোষণা দিলেন, আমরা একই সময়ে একযোগে অনলাইনে টিকেট নেব। বাংলাদেশ রেলওয়ের অ্যাপস থেকে বিকাশের মাধ্যমে পেমেন্ট দিয়ে টিকেট নেওয়া হলো। অন্য অনেকের মতো আমিও বেজায় খুশি। কারণ রেলভ্রমণ আমার কাছে স্বাপ্নিক মনে হয়। মৃদুমন্দ তালের ট্রেনযাত্রায় কত কিছু মনে আসে। রাতের জার্নি তো আরও বেশি রোমাঞ্চকর। এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে—রেলভ্রমণের সময় যাদের ফেলে আসা প্রিয় কোনও মুখ কিংবা স্মৃতির কথা মনে আসেনি। সচরাচর যেসব ভাবনা আমাদের মনে আসে না, কেবল রেলযাত্রায় সেসব ভাবনা উঁকি দেয়। রেলভ্রমণ যেন আমাদের জীবনের প্রতিরূপ। চলছে বিরামহীন, শুধু মাঝেমাঝে কিছু স্টেশনে বিরতি দিতে হয়। জীবন নামের রেলগাড়ি একসময় শেষ স্টেশনে গিয়ে চিরতরে থেমে যায়।

সুন্দরবনে কবি ও লেখক ফারুক সুমন। ছবি : লেখকের সৌজন্যে

কমলাপুর রেলওয়ে জংশন থেকে খুলনার উদ্দেশে চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেন ছেড়ে যাবে সন্ধ্যা ৭টায়। ফলে সকল জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। মিরপুর ১০-এর পূর্বনির্ধারিত স্থানে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন ময়নুল শাহ স্যার। কয়েকবার কলও দিয়েছেন। অবশ্য মিরপুরবাসী সাদ্দাম হোসেন স্যারও একসঙ্গে কমলাপুর যাওয়ার কথা। কিন্তু হঠাৎ পারিবারিক সমস্যার কারণে তিনি আর আমাদের সঙ্গে যেতে পারলেন না। জানালেন, তাঁর আসতে কিছুটা দেরি হবে। ময়নুল স্যার এবং আমি সিএনজি নিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনের দিকে ছুটলাম। ইতোমধ্যে ‘সুন্দরবন ভ্রমণ’ নামের ভাইবার গ্রুপে টুংটাং শব্দ হচ্ছে। নোটিফিকেশন চেক করে দেখি আমার অন্য সহকর্মীরা ছবি আপলোড দিচ্ছেন। তার মানে, শুরু হয়ে গেছে আনন্দযাত্রা। পিলখানাস্থ কলেজ ক্যাম্পাস থেকে দুটি বাস একযোগে কমলাপুর স্টেশনে যাচ্ছে। আমার অন্য সহকর্মীরা সেই বাসে আছেন। ভাইবার গ্রুপে তাঁরা মুহুর্মুহু সেলফি আপলোড দিচ্ছেন। জানান দিচ্ছেন, আমরা চলেছি আল্লাহর নামে। আমাদের ভ্রমণ শুরু হয়ে গেছে।

আমি এবং ময়নুল স্যার ট্রেন ছাড়ার প্রায় সোয়া ১ ঘণ্টা আগে কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছে যাই। এসে দেখি কাফেলার আর কেউ এখনও আসেননি। আলেফ স্যারকে কল দিয়ে জানলাম, কলেজ থেকে আগত দুটি বাস যানজটের কারণে এখনও পথে আছে। জানালেন, যেন স্টেশনের বাইরের পার্কিং-এ দাঁড়িয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করি। আমার একটা অভ্যাস, স্টেশন কিংবা জনাকীর্ণ কোনও চত্বরে গেলে তন্ময় হয়ে মানুষের আসা-যাওয়া দেখি। এই জগৎসংসারে কত বিচিত্ররকমের মানুষ। প্রতিটি মানুষের অভিব্যক্তি স্বতন্ত্র। সবাই বিরামহীনভাবে ছুটছে তো ছুটছে। যাঁরা স্টেশনে প্রবেশ করছেন ব্যাগবোচকা নিয়ে, তাঁদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। না জানি ট্রেন তাঁকে রেখে ছেড়ে যায়। আবার যাঁরা স্টেশন থেকে বেরোচ্ছেন, তাঁরা কিছুটা নির্ভার, চিন্তামুক্ত।

দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছি। কিন্তু প্রস্রাবের ঝাঁজালো গন্ধের তোড়ে পার্কিং-এর জায়গাটায় আর দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তবুও এখানেই দাঁড়াতে হবে। কারণ আমাদের বাস দুটি এখানেই থামবে। সবাই এখানে একত্র হয়ে তারপর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করবেন এমনটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাকে দাঁড়াতে বলে ময়নুল স্যার প্রক্ষালন কক্ষে গেলেন। অবশ্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিনি কাজ সেরে এলেন। তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলে আমিও ভাইবার গ্রুপে দিলাম। অন্যদের জানিয়ে দিলাম, সবার আগে কমলাপুরে আমরাই এসেছি।

ঠিক সাড়ে ছটায় বাস দুটি এসে থেমেছে। একে-একে সবাই নামলেন। কেউ কেউ স্বামীসন্তানদের সঙ্গে এনেছেন। শিফট ইনচার্জ রেজাউল করিম স্যার সাবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘যাঁরা যাঁরা সান্ধ্যকালীন নাস্তার প্যাকেট পাননি তারা দ্রুত প্যাকেট সংগ্রহ করুন।’ নাস্তার প্যাকেটের সঙ্গে কলেজের নামাঙ্কিত দৃষ্টিনন্দন একটি ক্যাপ আছে। যেখানে স্লোগান হিসেবে লেখা ‘সুবর্ণ বছরে সুন্দরবন।’ কবি আকমল হোসেন খোকনকে এই চমৎকার অর্থবহ স্লোগানের জন্য সাধুবাদ জানাতে হয়। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরকে তিনি স্লোগানের শব্দবিন্যাসে বেঁধেছেন। এই স্লোগান ইতিহাসের দায় ও দেশপ্রেমের প্রতিনিধিত্ব করেছে।

আমরা এবার স্টেশনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। মাইকে ঘোষণা এলো, খুলনাগামী চিত্রা এক্সপ্রেস আন্তঃনগর ট্রেন ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে যাবে। প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করে দেখি ট্রেন এখনও আসেনি। মিনিট দশেক পর ক্লান্তশ্রান্ত চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেন কেবল প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করেছে। খুলনা থেকে আগত যাত্রীরা হুড়মুড় করে নেমে গেল। আমরাও তড়িঘড়ি করে যার যার টিকেট অনুসারে বরাদ্দকৃত আসন দখলে নিই। শত মাইল পাড়ি দিয়ে যে ট্রেন মাত্র এলো, তার পর্যাপ্ত বিশ্রামের আগেই ইঞ্জিন বদল করে পুনরায় ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি। ফলে বগির ভেতর এখানে-ওখানে পড়ে থাকা কাগজের টুকরো, বাদামের খোসা ও ফলের বিচি পড়ে থাকল। এমনকি টয়লেট পরিষ্কার না করেই আবারও ট্রেন ছেড়েছে খুলনার উদ্দেশে। ফলে সারাপথ টয়লেটের দুর্গন্ধ ধৈর্য নিয়ে উপভোগ করা ছাড়া কোনও গত্যন্তর ছিল না!

সহকর্মীদের সঙ্গে কবি ও লেখক ফারুক সুমনের সেলফি। ছবি : লেখকের সৌজন্যে

গাড়ি ছেড়েছে। ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ট্রেনের গতি ছিল স্বাভাবিক। গাজীপুরের পর ক্রমশ ট্রেনের গতি বেড়ে যায়। গতি বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের মনের গতিও পরিবর্তিত হতে থাকে। গলা ছেড়ে গান গাওয়া শুরু করি। আমার সঙ্গে যোগ দিলেন যথাক্রমে আসাদ স্যার, ওয়াহিদ স্যার, মাহমুদ স্যার এবং ময়নুল স্যার। গান শুনে আশেপাশের অপরিচিত অনেক যাত্রীই মুগ্ধ। দুয়েকজন আবার গানও ধরেছেন। হলে কী হবে, বেরসিক কেউ একজন ইতোমধ্যে আমাদের ব্যাপারে পুলিশের কাছে নালিশ করেছেন। গানে তাদের হয়তো অসুবিধা হয়। কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল এবং রেলের কর্মকর্তা এসে গান বন্ধ করার অনুরোধ করলেন। কিন্তু কার কথা কে শোনে। পুলিশ চলে যাওয়ার পর আবারও গান শুরু হলো। ইতোমধ্যে সহকর্মী আসাদ স্যারকে আমি পরিচয় করিয়ে দিয়েছি সিরাজগঞ্জ জেলার আওয়ামীলীগের বড় নেতা হিসেবে। এতে সুবিধা হলো খুব। নেতার পরিচয়ে ট্রেনের কফি বিক্রেতা থেকে শুরু করে বাদাম বিক্রেতা, সবাই সমীহ করতে লাগল। কফিবিক্রেতার কাছ থেকে বিনামূল্যে ১ কাপ কফি অতিরিক্ত পাওয়া গেল। বোঝা গেল, রাজনৈতিক নেতার ক্ষমতা এ দেশকে গিলে খেয়েছে।

গানের ফাঁকে নাস্তার প্যাকেটে পাওয়া পরোটা এবং সবজিসমেত পোড়া মুরগি খেলাম। শীতে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া পরোটার শরীর এতই শক্ত হয়ে গেছে যে, টেনেটুনে পুরোটা শেষ করতে পারিনি। অবশ্য কমলা এবং স্যান্ডউইচ আয়েশ করে খেয়েছি। ট্রেনের ভেতর পৌষের শীতের দাপট তেমন ছিল না। ফলে না গরম না শীত, এমন আবহে ভ্রমণ বেশ উপভোগ্য ছিল। পথেপথে ছোটবড় অনেক স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। তবে ঈশ্বরদী স্টেশনে প্রায় পনেরো মিনিটের বিরতি পাওয়া গেল। আমরা এই সুযোগে ট্রেন থেকে নেমে পড়ি। বাইরে বেশ কুয়াশা। হিমহিম আবহে ধোঁয়াওড়া গরম চা খাচ্ছেন তরুণ কান্তি স্যার, কাজী সাইফুল্লাহ স্যার, অসীম স্যার, আকমল স্যার, মুনসুর স্যার, দুলাভাই জাহিদ হাসান, মাহমুদ স্যার, নূর হোসাইন স্যারসহ আরও অনেকে। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হলো। ভ্রমণপথে এই সামান্য বিরতিটুকু যেন মুহূর্তে বইয়ে দেয় অবারিত আনন্দতুফান।

সহযাত্রীরা রাত তিনটা পর্যন্ত সরগরম থাকলেও শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ভোর ৬টায় আমাদের ট্রেন খুলনা গিয়ে পৌঁছে। বগিভর্তি যাত্রীরা আড়মোড়া ভেঙে যার যার ব্যাগপত্র নিয়ে নামার জন্য উদ্যোগী হলেন। রেলস্টেশনের বাইরে আমাদের জন্য মুরাদনগর এক্সপ্রেস নামের দুটি বাস অপেক্ষমাণ। খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত এই দুটি বাস যাওয়ার কথা থাকলেও সিদ্ধান্তের বদল হয়েছে। ফলে ৮-১০ মিনিটের দূরত্বে গিয়ে বাস থেমে যায়। তাকিয়ে দেখি, এটা খুলনা বিআইডব্লিউটিএ-এর ৪ নম্বর ঘাট। শিফট ইনচার্জ তাহমিনা খাতুন ম্যাডাম জানালেন, যদিও মংলা থেকে আমাদের জাহাজযাত্রা হওয়ার কথা। কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়েছে, সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য ভাড়াকৃত এমভি খেয়াপার জাহাজ এই ঘাটেই আমাদের বরণ করবে।

সর্বাধিক পঠিত