১৮ অক্টোবর ২০২৪

কাঞ্চনজঙ্ঘা: একটি অনন্য সূর্যোদয়

ফরিদুর রহমান
০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১৫:৩৭
ফরিদুর রহমান অলঙ্করণ: কিশোর ডাইজেস্ট

আমরা একটি সুন্দর সূর্যোদয় দেখতে চেয়েছিলাম। আগের দিন আকাশ মেঘলা ছিল, টাইগার হিলে পৌঁছেছিলামও কিছুটা দেরিতে। মেঘলা আকাশে ঘোলা সূর্যের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রকৃত চেহারা দেখতে না পাওয়ার অপূর্ণতা নিয়ে দার্জিলিং থেকে ফিরে যাবার কোনও মানে হয় না। পর দিন তাই ভোর হবার অনেক আগে, রাত সাড়ে তিনটায় হোটেল থেকে বেরিয়ে যাত্রা করেছি। আমরা তিনটি জিপে আঠারো জন যাত্রী আর সামনে পুলিশের এসকর্ট। পশ্চিমবাংলা সরকারের অতিথি হিসাবে পথের বাঁ-পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাহনের দীর্ঘ সারি পাশকাটিয়ে একটু বাড়তি সুবিধা নিয়ে সূর্য ওঠার অনেক আগেই আমরা পৌঁছে গেছি টাইগার হিলের ভিউ পয়েন্টে।

প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী হিমালয় পর্বতমালায় সূর্য কিরণের অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য উপভোগের জন্য সমবেত হন টাইগার হিলে। আড়াই হাজার মিটারের কিছু বেশি উচ্চতায় এই ভিউ পয়েন্ট থেকে পুরো হিমালয়ান রেঞ্জ, বিশেষ করে কাঞ্চনজঙ্ঘার যে দৃশ্য চোখে পড়ে তার কোনও তুলনা হয় না। তবে আলোর এই উদ্ভাস দেখতে হলে পাড়ি দিতে হয় তেরো কিলোমিটার অন্ধকারের পথ। কোথাও পথের একপাশে পাহাড় অন্যপাশে গভীর গিরিখাত আবার কোথাও পাহাড়ের গায়ে বিভিন্ন স্তরে সাজানো বাড়ি। দুপাশের পাহাড় এবং বনভূমির মতোই বেশিরভাগ বাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে। শত শত গাড়ি আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে হেডলাইট না জ্বালিয়ে প্রায় নিঃশব্দে, যাতে গৃহবাসীদের ঘুম না ভাঙে।

টাইগার হিলের ভিউ পয়েন্টে বাংলাদেশের একদল পর্যটক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আমরা সুবিধাভোগী পর্যটক হয়ে দ্রুত টাইগার হিলের ভিউ পয়েন্টে উঠে গেলেও দেখা গেল আমাদের আগেই আরও অসংখ্য দর্শনাথী এসে জায়গা মতো দাঁড়িয়ে গেছেন। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কেবল মানুষের মাথা। দূরে চোখ মেলে তাকালে আবছা অন্ধকারে আকাশের গায়ে হেলান দেয়া পর্বতমালার সেলুলয়েড চোখে পড়ে। ভেবেছিলাম এ ভাবেই বোধহয় সূর্যোদয় পর্যন্ত অগণিত মানুষের মাথার উপর দিয়েই তাকিয়ে থাকতে হবে। কিছু পরেই আমাদের নাম ধরে ডেকে একত্রিত করা হলো। পেছনে কয়েকতলা উচ্চতা বিশিষ্ট ওয়াচ টাওয়ারের নির্মাণ কাজ এখনো শেষ হয়নি, ফলে সেখানে ওঠার ব্যবস্থাও নেই। কিন্তু প্রতিবেশি দেশ থেকে আসা বিশিষ্ট অতিথিদের জন্যে ব্যবস্থা হয়ে গেল। কোথাও থেকে কয়েকটা বালির বস্তা এনে প্রথম স্তরে উঠে পড়ার পরে আর কোনও সমস্যা হয়নি, সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেছি চতুর্থ কিংবা পঞ্চমতলা পর্যন্ত। এবারে কোথাও কোনও প্রতিবন্ধকতা নেই, সামনে কেবলি আকাশ, সামনে শুধুই দিগন্ত বিস্তৃত পর্বতমালা।

কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষে ঝলমল করতে থাকে সকালের সূর্য। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

প্রথম পর্যায়ে পাহাড়ের কয়েকটি স্তর চোখে পড়ে। হাজারও মানুষের হাতে হাতে জ্বলছে মোবাইল ফোনের বাতি, তারপরে অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে গায়ে বাতিজ্বলা দার্জিলিং শহর। আর বহু দূরে আকাশের পটভূমিতে উঁচু-নিচু পাহাড়ের সারি। পূবের আকাশ ধীরে ধীরে লাল হতে শুরু করলে অন্ধকারের উপরের স্তরে জেগে ওঠে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। আস্তে আস্তে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের উপরের স্তরে দেখা দেয় ধুসর পাহাড় আর পাহাড়ের ওপারে কুয়াশা ঢাকা নীলাভ পর্বতমালা। পূবের আকাশে ছড়িয়ে থাকা লাল আলোয় পর্বত চূড়া থেকে বিচ্ছুরিত হতে থাকে সোনালি রঙ। আলোর স্পর্শে ক্ষণে ক্ষণে বদলাতে থাকে আকাশের রঙ, বদলে যায় স্তরে স্তরে সাজানো পর্বতের রঙও। একটু পরেই নীলাভ পর্বতমালার উপরে মেঘের পরতে পরতে লাল রঙ মাখিয়ে উঁকি দেয় সূর্য। সববেত দর্শনার্থী উল্লাসে ফেটে পড়ে।

সূর্যের আলো বাড়তে থাকলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাহাড়ের গায়ে গাঢ় সবুজ বনভূমি। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষে ঝলমল করতে থাকে সকালের সূর্য। আমরা বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকি আসামান্য সৌন্দর্য ছড়ানো একটি ভোরের দিকে। আমাদের দলের সকলে সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে, ‘আকাশভরা সূর্য-তারা বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান!'

সর্বাধিক পঠিত