০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
মন কেমনের সুন্দরবন : পর্ব ২

সুন্দরবন দেখার তুমুল তৃষ্ণা

ফারুক সুমন
০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬:২৫
মন কেমনের সুন্দরবন। অলংকরণ : কিশোর ডাইজেস্ট

ভোর হয়েছে। যত দূর চোখ যায়, কেবল ঘন কুয়াশা। ঘাটে নোঙর করা সারি-সারি জাহাজ। খুব বেশি মানুষের আনাগোনা নেই। অল্প কিছু লোক ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করছে। তারা জাহাজের লোক হবে হয়তো। নদীর পাড়ে দুয়েকজন দোকানি চোখ কচলে শীতে জড়সড় হয়ে দোকান খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও জাহাজে নাস্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে, তবুও একটি দোকান থেকে ২ লিটার পানি এবং বিস্কুট কিনে জাহাজে উঠলাম। এম. ভি. খেয়াপার তিনতলা বিশিষ্ট মাঝারি মানের একটি জাহাজ। খুব বেশি চাকচিক্য না থাকলেও জাহাজে শান্তি শান্তি পরিবেশ বিরাজমান। মূলত এই শান্তির নেপথ্যে ছিল ট্যুর ম্যানেজমেন্টের আন্তরিকতাপূর্ণ আতিথ্য।

আমরা যারা ব্যাচেলর, মানে যাদের পরিবার সঙ্গে নেই, তাদের জন্য নিচতলায় রুম বরাদ্দ হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা দম্পতিদের জন্য বরাদ্দ। এটা খুব ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাস ছেড়ে সবাই এবার ভৈরব নদীতে ভেসেছি। আধাঘণ্টা পর বিআইডব্লিউটিএ-এর ৪ নম্বর ঘাট থেকে সাইরেন বাজিয়ে জাহাজ ছাড়ল। ভোরের কুয়াশা কেটে সূর্যের সোনালি আলো উঁকি দিচ্ছে। আমরা জাহাজের সম্মুখভাগে, কেউ বা জাহাজের উপরের ডেকে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছি সকালের সোনারোদ। যতই দেখি ততই মুগ্ধ হই। মুহূর্তে মনে এলো ‘নীল আকাশের নিচে’ ছায়াছবির কালজয়ী গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কী দরদ দিয়ে গেয়েছেন—

‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে 
বলো কোথায় তোমার দেশ
তোমার নেই কি চলার শেষ! ও নদীরে’...

জাহাজে ওঠার পর থেকে সুন্দরবন দর্শনের মনোবাসনা বেড়ে গেল। জাহাজ যতই এগোচ্ছে, ততই দুই পাড় ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। নদীর ছোট-ছোট ঢেউয়ে সূর্যের প্রতিচ্ছবি ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে দিগ্বিদিক। দুপুর ১টা নাগাদ আমাদের জাহাজ মংলাবন্দর গিয়ে পৌঁছে। সেখানে কিছু সময়ের জন্য নোঙর ফেলা হয়। কারণ কাফেলার কাণ্ডারি ভিপি স্যার আমাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন। তদারকির প্রয়োজনে তিনি আগের দিন সপরিবারে এসে মংলায় অবস্থান করছেন। স্যার জাহাজে ওঠার পর আবার জাহাজ চলতে শুরু করে। খুলনা থেকে যাওয়ার পথে দাওকোপ উপজেলা। নদীপাড়ে অসংখ্য ঘর। জাহাজের একজন সহকারী বললেন, এগুলো বানিয়াসান্তা নিষিদ্ধপল্লির ঘর। পশুর নদীর তীরবর্তী এই পল্লিতে বন্দি আছে অসহায় নারীদের নিশ্চল জীবন। কিছু দূর যেতেই চোখে পড়ে করমজল। মূলত এই করমজল পর্যটন এরিয়া থেকে সুন্দরবনের সীমানা শুরু হয়। তবে আমাদের জাহাজ করমজল ছাড়িয়ে সোজা চলে যায় হাড়বাড়িয়ার দিকে। ট্যুরের ম্যানেজার সোহরাব সাহেব জানালেন, ফেরার পথে আমরা করমজল পরিদর্শন করব।

সুন্দরবনে কবি ও লেখক ফারুক সুমন। ছবি : লেখকের সৌজন্যে

বিকেল ৩টা নাগাদ আমাদের জাহাজ হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছে। হাড়বাড়িয়া সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের অধীন বনবিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা ট্যুরিজম কেন্দ্র। খুলনা থেকে ৭০ কিলোমিটার এবং মংলা বন্দর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে এই কেন্দ্রের অবস্থান। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা ছোট খালের  টলমল জলে আমাদের ট্রলার ছুটছে। সবার গায়ে আগুনরঙের লাইফ জ্যাকেট। খালের দুধারে গোলপাতা গাছের সারি মুগ্ধতা ছড়ায়। গোলপাতা দেখতে গোল নয়, অনেকটা নারকেল গাছের পাতার মতো। আমাদের সঙ্গে থাকা গাইড জানালেন, এই খালটি কুমিরের অভয়ারণ্য। অবশ্য আমরা দুয়েকটি কুমির খালের চরে শুয়ে থাকতে দেখেছি। হয়তো তারা শীতবিকেলের রোদ পোহাচ্ছে।

ট্রলার হাড়বাড়িয়ার জেটিতে ভিড়েছে। সবার চোখেমুখে সুন্দরবন দেখার তুমুল তৃষ্ণা। এই হাড়বাড়িয়া দেখার মধ্যে দিয়ে বাস্তব নিকটে গিয়ে সুন্দরবন দেখা শুরু হলো। ঘাটে নেমে প্রথমে চোখে পড়ে ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রের সোনালি নামফলক। ফলকের সামনে দাঁড়িয়ে কে কার আগে ছবি তুলবেন সেই চেষ্টা চলছে। পুরো ভ্রমণজুড়ে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি, সবাই যার যার মোবাইলে প্রচুর ছবি তুলেছেন। ছবি তোলা এখন ভ্রমণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বটে। কারণ ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর এই ছবিগুলো স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবে। ডানপাশের ঘন জঙ্গলে চোখ যেতেই দেখি বিরল চিত্রাহরিণ। মানুষের আনাগোনা বুঝতে পেরে তারা দ্রুত জঙ্গলের গভীরে চলে যায়। অবশ্য বানরগুলো বেশ সাহসী। মানুষকে তেমন পাত্তা না দিয়ে দিব্যি লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। আজম স্যার বানরের ছবি তুলতে নিকটে গেলেন। একটি বানর বেশ খেপে যায়। লাফ দিয়ে এসে আজম স্যারের শার্টের কলার চেপে ধরে। একপাল বানর মুহূর্তের মধ্যে তাকে ঘিরে ধরে। কী ভয়ংকর অবস্থা! শাহনাজ জাহান খান ম্যাডাম এবং আমি এই দৃশ্য দেখে ভড়কে গেলাম। আজম স্যার ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলেন। ভাগ্য ভালো, মুহূর্তের মধ্যে বানরটি তাকে ছেড়ে দেয়।

সুন্দরবনে কবি ও লেখক ফারুক সুমন। ছবি : লেখকের সৌজন্যে

একটু সামনে এগোলেই সরু পথের ধারে বন-বিভাগের কয়েকটি ভবন। তারপর ছোট খালের ওপর ঝুলন্ত সেতু। এখানে কয়েক দফা ফটোসেশন শেষে যতই সামনে যাচ্ছি, ঘন জঙ্গলের পরিধি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে সামান্য সামনে গেলেই দেখা যাবে বিশাল এক পুকুর। ঘনজঙ্গল পরিবেষ্টিত পুকুরে ফুটে আছে লাল-সাদা শাপলা। পুকুরের মাঝখানে গোলপাতার ছাউনি দেয়া একটি ঘর। ঘরটির চারপাশে বসার জন্য বেঞ্চ রয়েছে। দর্শনার্থীরা পুকুরের পাড় থেকে কাঠের তৈরি সেতু দিয়ে হেঁটে সে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেন। পুকুরের পাশ দিয়ে ইট বিছানো পথে আমরা এগোচ্ছি। পথের দুই পাশে সামান্য নিচে কাদার ওপর হরিণের অসংখ্য পদছাপ। তবে হরিণের পদছাপের ভিড়ে বাঘের পদছাপ আবিষ্কারের আশায় সবাই কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছেন। বাঘমামার পায়ের ছাপ খুঁজে এত সহজ নয় বোধহয়। তবুও সবার মনে ভয়ভয় অবস্থা। এই বুঝি গভীর জঙ্গল থেকে হালুম হুংকারে বেরিয়ে আসবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। গা ছমছমে অনুভূতি নিয়ে পুকুর পেরিয়ে আমরা গভীর অরণ্যের পেটে ঢুকে যাচ্ছি। এভাবে মিনিট দশেক হাঁটার পর ইট বিছানো পথের শেষ হয়। এখানে তিনতলা বিশিষ্ট একটি ওয়াচ টাওয়ার। কাঠের তৈরি এই টাওয়ারের ওপর থেকে জঙ্গলের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দেখে মন ভরে যায়। তবে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দেখি বেশ নড়বড়ে অবস্থা। যে কোনও সময় ধসে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেকেই টাওয়ারে ওঠার চিন্তা বাদ দিলেন। আমিও টাওয়ার থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে পড়ি। ইটের রাস্তা শেষে বনের ভেতর দিয়ে প্রায় ১ কিলোমিটার কাঠের ট্রেইল অতিক্রম করতে হয়। ঘন জঙ্গলের নির্জনতা প্রমাণ করে, এখানে বাঘ থাকা অসম্ভব কিছু নয়। জানা-অজানা অসংখ্য গাছের ভিড়ে সুন্দরী, গেওয়া, গড়ান, গোলপাতা ছাড়া অধিকাংশ গাছই আমাদের কাছে অচেনা।

সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। গাছের ফাঁকে বিকেলের তেরচা রোদ হঠাৎ ঝিকমিক করে ওঠে। তবে এই আলো বেশিক্ষণ থাকবে না। শীতের রোদ হঠাৎ ঝড়ের কবলে পড়া বাতির মতোই আকস্মিক অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আমরা দ্রুত ট্রলারের দিকে হাঁটতে থাকি। বের হওয়ার পথে হাতের ডানে ঘন ঘাসের সবুজ গালিচা চোখে পড়ে। লোভ সামলাতে না পেরে ঘাসের উপর গিয়ে শুয়ে পড়ি। আহ, বহু দিন পর এমন তুলতুলে ঘাসে গা এলিয়ে দিলাম। আজম স্যার এবং শাহনাজ ম্যাডাম আমার কয়েকটি ছবি তুলে দিলেন। ঘাটে এসে দেখি বৃদ্ধ বয়সী দুজন নারী-পুরুষ ছোট্ট নৌকায় ভেসে-ভেসে ডাব বিক্রি করছেন। আজম স্যার, আলেফ স্যার, তসলিমা আফরিন ম্যাডাম, রেজাউল স্যার এবং তাঁর বন্ধু মনিরুল ইসলামসহ আরও অনেকেই প্রাণভরে ডাবের পানি পান করলাম।

সুন্দরবনে কবি ও লেখক ফারুক সুমন। ছবি : লেখকের সৌজন্যে

সন্ধ্যালগ্নে আমরা সবাই ট্রলারে চড়ে পুনরায় জাহাজে ফিরে গেলাম। পরবর্তী গন্তব্য কটকা সমুদ্রসৈকত। জাহাজ আবারও চলছে। আমরা যার-যার রুমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম শেষে তিনতলার ছাদে যাই। জাহাজের উঁচু পাটাতনে বসে বঙ্গোপসাগরের বিশুদ্ধ অক্সিজেন বুক ভরে টেনে নিচ্ছি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যে যার মতো খোশগল্পে মশগুল। কিছুক্ষণ পর নৈশভোজের ডাক এলো। তিন ধাপে খাওয়াদাওয়া চলে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অবগাহনের পাশাপাশি সুস্বাদু খাবারের কথা না লিখলে অন্যায় হবে বৈকি। অন্যদের ব্যাপারে বলতে পারব না। তবে আমার ক্ষেত্রে মনে হয়েছে—এ যেন শ্বশুরবাড়ি। একটু পর-পর নাশতা, চা-কফি। সামুদ্রিক মাছের নানানরকম রেসিপি। খাসি ও মুরগির গোশত তো ছিলই, সঙ্গে মাছের ভর্তা, সবজি, কোরাল মাছ ও হাঁসের মাংসের বারবিকিউ। এককথায় অবিশ্বাস্যরকমের আতিথেয়তা। এই ক্ষেত্রে ভিপি স্যারের বিনয়ী কর্মতৎপরতা উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেছে। আপ্যায়ন কমিটি এত চমৎকার শৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে কাজটি পরিচালনা করেছেন যে, তাঁদের বিশেষ ধন্যবাদ দিতেই হয়। রাতের আহারের আগে-পরে বিরামহীনভাবে চলেছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমাদের ছেলেমেয়েরা নাচ-গান ও কবিতা পরিবেশন করে উপস্থিত সবাইকে চমকে দিয়েছে। গানের তালে-তালে নূর হোসাইন স্যারের ব্রেক ড্যান্স আমাদের জন্য ছিল বাড়তি আকর্ষণ। প্রায় মাঝরাত অবধি চলে সেই আড্ডা-আয়োজন। এবারে ঘুমোতে যাবার পালা।

আরও পড়ুন

সুবর্ণ বছরে সুন্দরবন যাত্রা

সর্বাধিক পঠিত