বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। সেই সঙ্গে ডিসেম্বরের হিম হিম ঠাণ্ডা। এই সুবর্ণ সুযোগে বাবা-মায়ের সাথে গেলাম গ্রামের বাড়ি বরিশাল। রসের পিঠা-পায়েস, গুড়ের চা, মোয়া খেতে খেতে একদিন বাবা বললেন, চলো ১২৫ বছর পুরোনো একটা জায়গায় যাওয়া যাক! যেই বলা সেই কাজ। এক শীতের দুপুরের নরম রোদে বেরিয়ে পড়লাম বরদা বাবুর মঠ বা পঞ্চরত্ন মঠ দেখতে।
প্রায় ১২৫ বছর এই পুরোনো মঠটার অবস্থান ও ইতিহাস নিয়ে একটু না জানলেই নয়। ‘বরদা বাবুর মঠ’ বা ‘বাবুর বাড়ির মঠ’ নামে পরিচিত এই স্থাপনার অবস্থান বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলার কাউরিয়া বাজারসংলগ্ন গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নের পূর্ব কোড়ালিয়া গ্রামে। ১৮৯৯ সালে জমিদার বরদাকান্ত মিত্র নিজস্ব অর্থায়নে ভারতীয় শিল্পীদের কারুকার্যে রড সিমেন্ট ছাড়া শুধু ইট-চুনা দিয়ে এই শতবর্ষী মঠ নির্মাণ করিয়েছিলেন। দশ শতাংশ জমিতে একই পাটাতনের ওপর মাটি থেকে ৮০ ফুট উচ্চতার জোড়া মঠ দুইটির চূড়ায় রয়েছে তামা-কাঁসা ও মূল্যবান ধাতুর তৈরি কলস। মঠের গায়ে রয়েছে অজস্র দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য। প্রতিটি মন্দিরে পাঁচটি ছোট মিনারের মাঝখানে বড় কোণ আকৃতির চূড়া থাকায় অনেকে একে পঞ্চরত্ন মঠও বলে থাকেন।
মঠ বলা হলেও এটি আসলে বরদাকান্তবাবুর বাবা রামকানাই মিত্র ও মায়ের জোড়া সমাধিমন্দির। স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে ব্যতিক্রম ও দৃষ্টিনন্দন দুই তলা এই মঠ তৈরিতে সময় লেগেছিল দুই বছর। এর চারপাশে রয়েছে আরও প্রায় তিন একর জমি এবং পেছনে একটি পুকুর। কাছেই আছে জমিদার বাড়ির একটি নাটমন্দির।
কথিত আছে, নাটমন্দির এবং কখনও কখনও মঠেও বরদাকান্তবাবুর জীবদ্দশায় অনেক সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা, কালীপূজা অর্থাৎ সনাতন ধর্মের অনেক ধর্মীয় উৎসব আয়োজন করা হতো; দর্শনার্থীদের বিতরণ করা হতো মিষ্টি, নাড়ু, বাতাসা, চিড়া, মুড়ি, খই। কালের স্রোতে এখন সেই উৎসবের সাথে সাথে অনেক স্থাপনাও বিলীন হয়ে গেছে। ১৯৫১ সালে পার্শ্ববর্তী উপজেলা মুলাদিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভয়াবহ রূপ নিলে ওই বছরই জমিদার বরদাকান্তের বংশধরেরা দেশান্তরী হন।
মঠটির পাটাতনের নিচতলায় রয়েছে দুটি অন্ধকার কুঠুরি, যা ১৯০৫ সালে নির্মিত হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের মতে, এগুলো ছিল পুরোহিতদের রান্নাঘর। ওপরতলার মূল জোড়া মঠেও রয়েছে একটি করে তিন দিক উন্মুক্ত কক্ষ আর মঠের সামনে থেকে নেমে গেছে ২২টি সিঁড়ি।
সমাধিমন্দির নিয়ে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত আছে মজার মজার সব গল্পকথা। জনশ্রুতি আছে, চূড়ার কলসে আসলে অনেক টাকা আছে, যা পূর্ণিমার রাতে কেউ নামাতে পারলে সে অনেক সম্পদের মালিক হবে। আরও বলা হয়, পূজার সময় রাতে নিচতলার কাছ থেকে খাবারের ঘ্রাণ পাওয়া যায় এবং ২২টি সিঁড়িতে সাদা পোশাকের পুরোহিতদের বসে থাকতে দেখা যায়।
প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্যের এই অসাধারণ জায়গাটিতে যেতে হলে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ ফেরি পার হয়ে যেতে হবে কাউরিয়া বাজার থেকে মৌলভীরহাট সড়ক ধরে ৬০০ মিটার দূরত্বে।
অতি প্রাচীন এই মঠ দেখে আমরা যখন বাড়ি ফিরছি, তখন পড়ন্ত বিকেল। সোনালি রোদ ঘন গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে পড়ছে মঠের চারদিকে ও সিঁড়িগুলোতে। দেখে যেন অদ্ভুত এক রহস্যময়তা আর মুগ্ধতা সাথে নিয়ে ফিরে এলাম বাড়িতে।
লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।