১৮ অক্টোবর ২০২৪
মন কেমনের সুন্দরবন : পর্ব ৩

প্রথম রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখার আনন্দঘন মুহূর্ত

ফারুক সুমন
১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১৩:৩৯
মন কেমনের সুন্দরবন। অলংকরণ : কিশোর ডাইজেস্ট

গভীর রাত। এম ভি খেয়াপার জাহাজে ভেসে আছি বঙ্গোপসাগরে। বিরামহীন ইঞ্জিনের গরগর শব্দ। দূর থেকে ভেসে আসে অন্য কোনও জাহাজের সাইরেন। অসীম আকাশে কয়েকটি তারা মিটমিট করে জ্বলছে। কোথাও কেউ নেই। পানিতে কুমির। ডাঙায় বাঘ। জাহাজের অন্য সবাই ভ্রমণক্লান্তির ভারে গভীর ঘুমে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। শূন্য লাগছে। বিস্ময়ে হতবাক। এই বিচিত্র চরাচরে কত সামান্য তুচ্ছতা নিয়ে আমাদের বাহাদুরি। অথচ গহীন সুন্দরবনের খুব ভেতর যাওয়া হলো না। শোনা হলো না জঙ্গলের নিস্তব্ধ ও নির্জনতার ভাষা। জীবনের ঝুঁকি আছে বিধায় এটা সম্ভবও নয়। বিস্তীর্ণ জলরাশি কোথা থেকে এসে কোথায় চলে যায়। এ-এক অভাবনীয় ভ্রমণ। স্রষ্টা যেন জল-জঙ্গলের মহাকাব্যিক আখ্যান ছড়িয়ে দিয়েছেন। এ-যেন  আধ্যাত্মিকতার এক রহস্যময় আচ্ছাদন। আমরা তার কতটুকুই বা জানি। সুন্দরবন বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। বিস্ময়কর এই বন পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকায় অবস্থিত। পৃথিবীর বৃহত্তম লবণাক্ত এই বনাঞ্চলের আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। যার ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়েছে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব-ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সুন্দরবনকে স্বীকৃতি প্রদান করে।

তখন রাত প্রায় ২টা। আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না। কেবিন ছেড়ে আবারও বাইরে এলাম। একা একা পুরো জাহাজ হেঁটে দেখলাম। নাবিকের কক্ষে গিয়ে দেখি তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে জাহাজ চালাচ্ছেন। মাঝেমাঝে ওয়ারলেসে অন্য কোনো জাহাজের নাবিকের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি কৌতূহল নিয়ে চুপচাপ তার পাশে বসে এসব দেখছি। একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘স্যার আপনি ঘুমাননি?’ না ঘুম আসছে না। তাই এদিকে হাঁটতে এলাম। এবার তিনি নিজে থেকেই গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলেন। তার নাম ইমরান। ১৫ বছর যাবৎ জাহাজের সারেং হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা থাকলে কী হবে, যোগ্যতা অনুযায়ী যে পরিমাণ বেতন পাওয়ার কথা, তাকে সেটা দেওয়া হয় না। কারণ তার প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট নাই। ব্যক্তিগত জীবনের পাওয়া না পাওয়ার গল্প আমাকে শোনালেন। এই সমুদ্রে কাজ করার কারণে পরিবারের সংস্পর্শ থেকে তিনি বঞ্চিত হন। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক ও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন না। দিনের পর দিন জাহাজে-জাহাজে কেটে যায়। তিনি যখন প্রথম কন্যা সন্তানের বাবা হলেন। সেই সুসংবাদ তার কাছে পৌঁছে কন্যা জন্মের তিন দিন পর। এই ঘটনা ভুলতে পারেন না। এত কিছুর পরেও  সমুদ্রকে ভালোবাসেন। কাজ করতে করতে এতই নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে গেছেন যে, চেষ্টা করেও আর অন্য কোনও কাজে গিয়ে স্থির হতে পারেননি।

প্রায় ঘণ্টাখানেক তার সঙ্গে আলাপ শেষে কেবিনে এলাম। ঘুমুতে না ঘুমুতে হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেলো। জলদস্যুর আক্রমণ নয় তো! না, সেরকম কিছু নয়। তাকিয়ে দেখি জাহাজ থেমে আছে। ইতোমধ্যে নোঙর ফেলা হয়েছে। জাহাজের গা ঘেঁষে ভেসে আছে ট্রলার। এখনই সবাইকে কটকা সি-বিচে যেতে হবে। ভোরে-ভোরে না গেলে বাঘ-হরিণের দেখা মিলবে না। তড়িৎগতিতে তৈরি হয়ে ট্রলারে উঠলাম। সুন্দরবনের দৃষ্টিনন্দন স্থান গুলোর মধ্যে কটকা অন্যতম। মংলা বন্দর থেকে এর দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার। কয়রা উপজেলার কয়রা ইউনিয়নে অবস্থিত এই বিচ দেখার জন্য প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম ঘটেছে। আমরা ছাড়াও ইতোমধ্যে আরও কয়েকটি ট্রলার কটকা ঘাটে এসে ভিড়েছে।

সুন্দরবনে কবি ও লেখক ফারুক সুমন। ছবি : লেখকের সৌজন্যে

তখনো সূর্য ওঠেনি। ঘন কুয়াশা থাকলেও তুলনায় ঠাণ্ডা অনেক কম। বাধ্য হয়ে গায়ের অতিরিক্ত জ্যাকেট খুলে হাতে নিতে হলো। প্রথমে কিছু পথ ইটবিছানো। তারপর বনের সমতল ভূমিই পথের নিশানা পেয়েছে। আমরা সারিবদ্ধভাবে হাঁটছি। সবার হাতে ১টি কমলা ও ১ বোতল পানি। আগে-পিছে বন্দুক হাতে দুজন গানম্যান। কটকাতে রয়েছে ৪০ ফুট উঁচু একটি ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ার থেকে সোজা উত্তরে কটকা সমুদ্রসৈকত। কটকা সি-বিচ স্থানীয়দের কাছে জামতলা সমুদ্রসৈকত নামে পরিচিত। মজার ব্যাপার হলো, ঘাট থেকে হাঁটাপথে যাওয়ার সময় দুইপাশে অসংখ্য জামগাছ চোখে পড়ে। এই সৈকত বুনো সুন্দরী। প্রায় তিন কিলোমিটার ঘন সুন্দরী, গেওয়া, গরান, এবং কেওড়ার বন পেরিয়ে সৈকতে যেতে হয়। জামতলা সমুদ্র সৈকতের পথে শুধু ম্যানগ্রোভ বন নয়, বেশ খানিকটা ফার্নের ঝোপও রয়েছে। সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটছি। ট্যুর ম্যানেজার সোহরাব ভাইয়ের ভাষ্যমতে, যাওয়া-আসা সবমিলিয়ে ৭কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। পথের দুইপাশে ঘন অরণ্যের গভীরে বাঘ থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে হাঁটাপথে হরিণ এবং বানরের দেখা পেয়েছি। হরিণ সদাচঞ্চলা হলেও সুন্দরবনের বানরেরা মানুষ দেখে একেবারেই নির্বিকার। কোনও রকম ভয়ডর নেই। মানুষকে তারা বোধহয় সগোত্রীয় মনে করে।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সামনে এসে যায় জামতলা সমুদ্রসৈকত। অপূর্ব সুন্দর সৈকত দেখে সবাই উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। ভোরের সূর্যমামা লালটুকটুকে মুখখানি দেখালেন। আহা, সে কী অপূর্ব দৃশ্য! যেন বঙ্গোপসাগরের পেট থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসছে দিনমণি। মৃদু ঢেউয়ে সূর্যরশ্মি ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে। এই অনিন্দ্য সুন্দর মুহূর্তটি ধরে রাখার জন্য চারিদিকে ছবি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। আমি, আজম স্যার এবং মাহমুদ স্যার পরস্পরের ছবি তুলে দিই। বেশ নির্জন ও পরিচ্ছন্ন সৈকতের বেলাভূমির এখানে-ওখানে পড়ে আছে বড়-বড় গাছের গুড়ি ও শিকড়। ঝড়ের কবলে পড়া গাছের অবশিষ্টাংশ পানিতে ভেসে ভেসে এসেছে। এখানে গোসল করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সঙ্গে থাকা গানম্যান আমাকে নিষেধ করলেন। বললেন, এই জায়গাটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে চোরাবালিতে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ২০০৪ সালের ১৩ মার্চ এখানে বেড়াতে গিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের নয় জন ও বুয়েটের দুই জন শিক্ষার্থী সমুদ্রে ডুবে মারা যায়।

কিছুক্ষণ অবস্থান শেষে উপাধ্যক্ষ স্যার ট্রলারে ফেরার তাড়া দিলেন। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বনবিভাগের কার্যালয়। প্রায় সবাই ট্রলারে গেলেও ৮-১০ জন দলছুট হয়ে যান। তারা হলেন—কাজী সাইফুল্লাহ স্যার, নূর হোসেন স্যার, ময়নুল স্যার, শিশির স্যার, ওয়াহিদ স্যার, সাদ্দাম স্যার, এবং আসাদ স্যার। আমি উদ্যোগী হয়ে সাইফুল্লাহ স্যারের টেলিটক নম্বরে কল দিই। তিনি বললেন, জামতলা বিচ থেকে মিনিট দশেক হেঁটে সামনে এগোলে আরও একটি বিচ পাবেন। আমরা সেখানে আছি। আমি আজম স্যার এবং মাহমুদ স্যারকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেলাম। এই বিচটিও বেশ মনোরম। তবে এখানে বেশি সময় থাকা হলো না। কারণ, আমাদের জন্য অন্য সবাই ট্রলারে অপেক্ষমাণ। ফেরার পথে কাজী সাইফুল্লাহ স্যার বললেন, তিনি বাঘের পদছাপ দেখেছেন। প্রমাণস্বরূপ সেটার ছবিও তুলে রেখেছেন।

কটকা খালের পশ্চিম পাড়ে বন-বিভাগের কার্যালয়। জামতলা বিচ দেখে ট্রলার এবার অনতিদূরের পশ্চিম পাড়ের ঘাটে গিয়ে ভিড়ে। পাড়ে উঠে একটু পশ্চিমে এগুলে ইটবাঁধানো সংক্ষিপ্ত পথ। বামপাশে বন-বিভাগের কার্যালয় ও অফিস পার্ক। অফিস পার্ক পেছনে রেখে আরও একটু সামনে এগোলে টাইগার টিলা ও গরান বাগান। টাইগার টিলা নামকরণের কারণ, এখানে মাঝেমাঝে বাঘ দেখা যায়। দর্শনার্থীরা অনেকেই বাঘের পদছাপ খুঁজে পেয়েছে। তবে আমি বাঘের পদছাপ দেখে মোটেও তুষ্ট নই। যদি সচক্ষে রয়েল বেঙ্গল টাইগার না দেখে যেতে পারি তাহলে মনে আফসোস থেকে যাবে। গরান বাগানে হরিণের অজস্র পায়ের ছাপ। ওই তো দূরে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে পাতা খুটে খাচ্ছে চিত্রাহরিণের পাল। একটা-দুটো নয়, অগণিত হরিণ সকালের সোনারোদে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমরা ছাড়াও আরও অনেক দর্শনার্থী হরিণ দেখার জন্য ভিড় করেছে। সবার হাতেই ক্যামেরা। কেউ ছবি তুলছে, কেউ বা ভিডিও করছে। ছুটছে হরিণের পিছু। পায়ে-পায়ে ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদের শ্বাসমূল। এগুলো দেখতে নরম মনে হলেও মোটেও নরম নয়। বেশ শক্ত। আমার পাশে গানম্যান বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার কাছ থেকে বন্দুক চেয়ে নিয়ে আমি জলদস্যু টাইপের একটা ছবি তুলি।

সুন্দরবনে কবি ও লেখক ফারুক সুমন। ছবি : লেখকের সৌজন্যে

এখানে অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়ে আছে। পাতাশূন্য মরা গাছ যেমন দাঁড়িয়ে, তেমনই বড় বড় গাছের গোড়াও শিকড়সহ উপড়ে থাকতে দেখেছি। এসব দেখে মন খারাপ হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন বুকচিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝড়ের কবলে নিজেকে সঁপে দিয়ে রক্ষা করে সমগ্র দেশ। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঝড় প্রথমেই সুন্দরবনে আছড়ে পড়ে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ১০০ বছরে বঙ্গোপসাগরে পাঁচ শতাধিক ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। এর ১৭ শতাংশ আঘাত হানে বাংলাদেশে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে যত ঝড় বয়ে গেছে, প্রতিবারই তা থেকে মানুষের জীবন ও সম্পদ অনেকাংশে রক্ষা করেছে সুন্দরবন। বিভিন্নসময়ে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত সুন্দরবনের কিছু ছবি ক্যামেরায় ধারণ করেছি। শিকড় উপড়ে মাটিতে পড়ে আছে এমন একটি গাছের ওপর শুয়ে আছেন আলেপ স্যার। আসাদ স্যার সেই দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণ করলেন। আলেপ স্যারের অজান্তে আমিও তার পেছনে গিয়ে মারার ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে যাই।

সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঘাটে এলাম। ট্রলার প্রস্তত। আবারও জাহাজে। এবার অভিমুখ হিরণ পয়েন্ট। ইতোমধ্যে সকাল পেরিয়ে প্রায় দুপুর। ঝকঝকে শীতরোদ পোহানোর লোভে কেবিন থেকে বের হয়ে ছাদে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মী মিজান স্যারের সঙ্গে দেখা। স্যার নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন গোসল করেছি কিনা। বললাম, না এখনও করিনি। তিনি বঙ্গোপসাগরের জলে কেবল গোসল করে ফিরলেন। আমাকেও ইঙ্গিতে দেখালেন কোথায় কীভাবে গোসল করা যায়। জাহাজের ঠিক পেছন দিকে ডেকে দাঁড়িয়ে গোসল করতে হবে। সেখানে বড়-ছোট সাইজের ২টি বালতি ও মগ রাখা আছে। কুয়োতলা থেকে বালতি ফেলে পানি তোলার মতো এখানেও তা-ই করতে হবে। তবে বঙ্গোপসাগরের স্রোতবহা পানিতে বালতি ফেলে পানি টেনে তোলা কিছুটা বিপজ্জনক। মনে সাহস সঞ্চার করেছি এই ভেবে, মিজান স্যার যেহেতু পেরেছেন আমিও পারব। গিয়ে দেখি নূরুল আলম স্যারও সেখানে গোসল করছেন। তাকে দেখে মনে জোর পেলাম। অবশ্য জাহাজের পেছনে বেঁধে রাখা ছোট ট্রলারে বসে রোদ পোহাচ্ছেন সঞ্জয় স্যার। তাকে অনুরোধ করলাম আমাকে দেখে রাখতে। আল্লাহর নাম নিয়ে বালতি ফেললাম জাহাজের পেছনে তীব্র স্রোতে। মনে ভয়, যদি স্রোতের তোড়ে নিজেকে সামলে রাখতে না পারি তবে নির্ঘাত সাগরে গিয়ে পড়তে হবে। পানি তুলে গায়ে ঢালছি। একটু পানি মুখে যেতেই বুঝলাম বেশ লবণাক্ত। নাহ, ফেলে না দিয়ে গিলে ফেলাই ভালো। মিজান স্যারের ভাষ্যমতে, সাগরের জল শরীরের জন্য ঔষধের কাজ করে। খুব সন্তর্পণে সাবধানতার সঙ্গে গোসল সারলাম।

হিরণ পয়েন্ট যাওয়ার পথে খালের দুই ধারের দৃশ্য সবচেয়ে বেশি মনোরম মনে হলো। কিছুটা সরু এবং নিকটবর্তী তীর হওয়ায় দুই ধারে নানাপ্রজাতির হরিণ, বানর, কুমির এবং পাখপাখালির ওড়াওড়ি চোখে পড়ে। তবে আপাতত এসবের চেয়ে আমার চোখ ব্যাকুল হয়ে আছে বাঘের খোঁজে। সুন্দরবনে সচক্ষে বাঘ দেখব, ভাবতেই ভালো লাগে। জাহাজের মাস্তুলে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগ। যদিও হাতে বন্দুক নেই। তবুও বাঘমামার দর্শন পেতে দক্ষ শিকারির মতো চারদিকে চোখ রাখছি। বলা যায়, প্রার্থনা করছি। আমার পাশে আলেফ স্যার, কাজী সাইফুল্লাহ স্যার, রেজাউল স্যার এবং নাদিরা ম্যাডামও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু না, বাঘমামার দর্শন পেলাম না। ইতোমধ্যে মধ্যাহ্নভোজের ডাক এলো। খাবারের এত চমৎকার আয়োজন দেখে আমার মতো প্রায় সবার চোখেমুখে পরিতৃপ্তির হাসি। আগেই বলেছি, সুন্দরবন ভ্রমণে এসে যেন শ্বশুরবাড়ির আপ্যায়ন পেয়েছি।

সুন্দরবনে সহকর্মীদের সঙ্গে কবি ও লেখক ফারুক সুমন। ছবি : লেখকের সৌজন্যে

মধ্যাহ্নভোজ শেষে হিরণ পয়েন্ট যেতে যেতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে যায়। জাহাজ হিরণ পয়েন্টের কাছাকাছি গিয়ে নোঙর ফেলে। আমি, ময়নুল স্যার, শিশির স্যার, সাদ্দাম স্যার, নূর হোসাইন স্যার এবং মাহমুদ স্যারসহ প্রায় ৪০ জন প্রথম ধাপে ট্রলারে চড়ে হিরণ পয়েন্টে পৌঁছালাম। বাকি ৪০ জনকে আনার জন্য ট্রলার পুনরায় জাহাজে ফিরে গেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, হিরণ পয়েন্ট হলো বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লোনা পানির বন। সুন্দরবনের দক্ষিণাংশের একটি সংরক্ষিত অভয়ারণ্য। এর আরেক নাম নীলকমল। প্রমত্তা কুঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে, খুলনা রেঞ্জে এর অবস্থান। হিরণ পয়েন্ট ইউনেস্কো ঘোষিত অন্যতম একটি বিশ্ব-ঐতিহ্য। হিরণ পয়েন্টের ঘাট থেকে সামান্য সামনে এগুলে প্রথমেই চোখে পড়ে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব-ঐতিহ্যের নামফলক। সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য দর্শনার্থীদের প্রচুর ভিড় লক্ষ করলাম। অবশ্য ফিরতি পথে আমরাও এখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। নেভি ক্যাম্প থাকার কারণে জায়গাটি বেশ উন্নত হলেও বনের প্রাকৃতিক শোভা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম। অভয়ারণ্য হওয়ায় সহজেই হরিণ, বানর, পাখি এবং সরিসৃপের দেখা মেলে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে এখানেও বাঘমামার দেখা পাওয়া কঠিন কিছু নয়। পাশেই দৃষ্টিনন্দন মিঠাপানির পুকুর। চারপাশে সারি-সারি নারকেল গাছ ও বাঁধানো ঘাট দর্শনার্থীদের মুগ্ধতা বাড়িয়ে দেয়।  

সন্ধ্যা হওয়ার ঠিক আগমুহূর্ত। আমাদের ট্রলার হিরণ পয়েন্ট ছেড়ে জাহাজের উদ্দেশ্যে ছুটছে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি বাঘমামা শুয়ে আছেন। খালের পাড়ে ঘন অরণ্যের ভেতর এভাবে আকস্মিক বাঘ দেখে আমি চিৎকার করে উঠি। সঙ্গে থাকা অন্যরাও মুহূর্তে লাফিয়ে ওঠেন। কবি আকমল হোসেন খোকন, আলেফ স্যারসহ আরও অনেকেই দেখেছেন। তবে যারা দেখেননি তারা এটাকে গুজব বলে উড়িয়ে দেবেন বৈকি। যাক, অবশেষে সুন্দরবন এসে সচক্ষে রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখার ঐকান্তিক ইচ্ছা পূর্ণ হলো।

আরও পড়ুন

সুবর্ণ বছরে সুন্দরবন যাত্রা

সুন্দরবন দেখার তুমুল তৃষ্ণা

সর্বাধিক পঠিত